Advertisement
০৮ নভেম্বর ২০২৪

হাসপাতালে যন্ত্রণার নিশিযাপন

হাসপাতালের ভিতরের সৌন্দর্যায়নেও লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করা হচ্ছে। কিন্তু কলকাতার সেই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি হাসপাতালগুলিতে কেমন ভাবে রাত কাটাচ্ছেন রোগীর পরিজনেরা? সম্প্রতি চারটি হাসপাতালে ঘুরে তারই খোঁজ নিল আনন্দবাজার।

শান্তনু ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৭ ০১:০৮
Share: Save:

কয়েক কোটি টাকা খরচ করে বসছে বড় গেট। বিল্ডিংয়ের পুরনো রং খসিয়ে নতুন রঙের প্রলেপ পড়ছে। হাসপাতালের ভিতরের সৌন্দর্যায়নেও লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করা হচ্ছে। কিন্তু কলকাতার সেই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি হাসপাতালগুলিতে কেমন ভাবে রাত কাটাচ্ছেন রোগীর পরিজনেরা? সম্প্রতি চারটি হাসপাতালে ঘুরে তারই খোঁজ নিল আনন্দবাজার। অন্য হাসপাতালগুলির ছবিও এর চেয়ে আলাদা কিছু নয়।

•এসএসকেএম

রাত ১০টা। সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সামনে প্লাস্টিক পেতে শোওয়ার তোড়জোড় করছেন বেশ কয়েকজন পুরুষ-মহিলা। হঠাৎ মেঘ ডাকতেই এক জন বললেন, ‘‘গরমে সেদ্ধ হই সেও ভাল, তবু যেন বৃষ্টি না আসে! বৃষ্টি এলেই আবার কোথাও ছুটতে হবে।’’ যদিও ওই বিভাগের পাশেই রয়েছে ঝাঁ চকচকে প্রতীক্ষালয়। সেখানে ঘেঁষাঘেঁষি করে শুয়ে রয়েছেন অসংখ্য মানুষ। সেখানে শুতে গেলে নাকি ‘গেট পাস’ লাগে। যদিও যাঁরা শুয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশের কাছেই ‘গেট পাস’ নেই। তা হলে
কে রোগীর আত্মীয় আর কে বহিরাগত তা বোঝা যাবে কী ভাবে? প্রশ্ন করতেই এক নিরাপত্তারক্ষী ঠোঁট ওল্টালেন। হাসপাতালের অন্যান্য বিল্ডিংয়ের নীচেও গাদাগাদি করে শুয়ে রয়েছেন বহু মানুষ। প্রতীক্ষালয়ে ঠাঁই হয়নি তাঁদেরও। অভিযোগ করলেন, রাতে হাসপাতাল চত্বরে নেশার আসর বসে। মেয়েদের শৌচালয়ে যাওয়ার দরকার হলেও ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

•ন্যাশনাল মেডিক্যাল

চার বছরের ছেলের মাথায় জল জমেছে। তাই টানা ১৭ দিন ধরে রামমোহন ব্লকের সামনের টিনের ছাউনির নীচেই মশারি টাঙিয়ে থাকছেন ফ্রেজারগঞ্জের শ্রীদাম দাস। মেঘের গর্জন শুনলেই বারবার উঠে বসছেন। কারণ, তিনি যে ছাউনির নীচে রয়েছেন হাওয়া দিলেই তা ভেঙে উড়ে যাওয়ার জোগাড়। শুধু
ওই ব্লকের সামনে নয়, গোটা হাসপাতাল জুড়ে রাতে থাকার জন্য যে টিনের ছাউনি রয়েছে সব ক’টিরই
বেহাল অবস্থা। রোগীর আত্মীয়দের কথায়, এই ছাউনিগুলি ছাড়া রাতে থাকার অন্য কোনও বিকল্প ব্যবস্থা নেই এই হাসপাতালে।

(৩) বি সি রায় শিশু হাসপাতাল (৪) এসএসকেএম

•এন আর এস

হাসপাতালের মেন গেট দিয়ে ঢুকেই থমকে দাঁড়াতে হল। শতবার্ষিকী ভবনের উল্টো দিকে ফাঁকা জায়গায় বিক্ষিপ্ত ভাবে গাছের ডাল মাটিতে পোঁতার চেষ্টা করছেন বেশ কয়েক জন। কেউ আবার খুঁটি পুঁতে
তাতে মশারি টাঙিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন। এক ঝলক দেখলে মনে হতেই পারে কোনও ত্রাণ শিবির। যদিও ওই ভবনের পিছনে
পুকুরের পাশেই রয়েছে চারতলা রাত্রিবাস। তবে সেখানে মাথাপিছু ৭৫ টাকা দিলে তবেই থাকা যায়। কর্মীদের দাবি, ‘‘শুধু রাতে থাকার জন্য কে আর ৭৫ টাকা দেবে? তাই সব প্রমাণপত্র দেখে ২৪ ঘণ্টার জন্যই ভাড়া দেওয়া হয়।’’ অভিযোগ, ভাড়া নেন বহিরাগতেরাও।

•বি সি রায় শিশু হাসপাতাল

অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের সামনে আচমকা পৌঁছলে যে কেউ মনে করতেই
পারেন, কোনও ঝুপড়ি লাগোয়া হাসপাতালে চলে এসেছেন। যদিও এই ঝুপড়িতে জায়গা পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার বলে দাবি শিশুর পরিজনদের। যেমন, বাদুড়িয়ার বাসিন্দা মইউদ্দিন বলেন, ‘‘এক মাস ধরে রাস্তাতেই থাকতাম। কয়েক দিন আগে এক জন ছেড়ে দিতে এখানে জায়গা পেয়েছি।’’ যদিও
এই হাসপাতালে দু’টি প্রতীক্ষালয় রয়েছে। কিন্তু সেখানে থাকতে গেলে টাকা লাগে। আর সেই সামর্থ্য বেশির ভাগ মানু‌ষের নেই বলেই দাবি করলেন হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষীরা। কিন্তু গোটা হাসপাতাল চত্বর জুড়ে প্লাস্টিকের ছাউনিতে কোনও ভাবে আগুন লাগলে তো ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে যাবে? প্রশ্নে নিরুত্তর সকলেই।

•আর জি কর

মেন গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে বাঁ দিকে ঘুরলেই ঝলমলে আলোয় যে ছবিটা চোখে পড়ে তা দেখে মনে
হতেই পারে, এখানে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে তারা গুনে রাত কাটানোটাই দস্তুর। ট্রমা সেন্টার ও মেটারনিটি সেন্টারের সামনে কংক্রিটের বাঁধানো চত্বরে শুয়ে রোগীর পরিজনেরা। আর আইসিসিইউ ভবনের সামনে টিনের ছাউনি দেওয়া প্রতীক্ষালয়ে তিল ধারণের জায়গা নেই। গাদাগাদি করে শুয়ে রয়েছেন অসংখ্য মানুষ। মাথার উপরে ঘুরছে মান্ধাতার
আমলের চারটি পাখা। সারিফুল বিশ্বাস নামের এক যুবকের অভিযোগ, ‘‘গোটা হাসপাতালে মাত্র দুটো
টিনের ছাউনি দেওয়া প্রতীক্ষালয় রয়েছে। তাতেও এক এক জন কয়েক মাস ধরে রয়েছেন।’’

•কী বলছে স্বাস্থ্য দফতর

রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘হাসপাতালগুলিতে আরও প্রতীক্ষালয় বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে গোটা রাজ্য থেকে রোগীদের যে পরিমাণ আত্মীয় কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে আসেন, তত জনকে রাতে থাকতে দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা করার মতো এত জমিও
তো নেই। হাসপাতালের ভিতরে জায়গা পাওয়া গেলে সবার আগে আরও বেড বাড়ানোর জন্য ভবন বানানো হবে।’’

ছবি: রণজিৎ নন্দী

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE