মূল চুক্তিপত্র বহু দিন হল গায়েব। অথচ তারই প্রতিলিপির ভিত্তিতে ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে নতুন ভাবে (সাপ্লিমেন্টারি) চুক্তি করেছে কলকাতা পুরসভা, যার মারফত ষাট বছরের লিজ-চুক্তিকে তিরিশ বছর করে দু’ভাগে ভেঙে লেক মলের ওই ডেভেলপার সংস্থাকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। এতে সরকারি কোষাগারে প্রায় ২৪ কোটি টাকা আয় কমছে।
লিজ-মেয়াদে ‘অবৈধ’ বিভাজনের খবর আনন্দবাজারে প্রকাশিত হওয়ার পরে ইতিমধ্যে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। মূল চুক্তিপত্র বেপাত্তা হওয়ার নতুন তথ্যের ইন্ধনে যা আরও জোরদার। প্রশ্ন উঠেছে, মূল যে চুক্তিপত্রের হদিসই নেই, তার জের টেনে কী ভাবে ভেঙ্কটেশের সঙ্গে সাপ্লিমেন্টারি চুক্তি করা হল? পুর-কর্তারা মুখ খুলতে নারাজ। মেয়রের দাবি, চুক্তিপত্র উধাওয়ের কথা তিনি জানেন না।
পুর-সূত্রের খবর: লেক মল পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ১৯৮৭-তে বড়বাজারের সংস্থা অরুণ প্লাস্টিকের সঙ্গে কলকাতা পুরসভার চুক্তি হয়েছিল। পুরসভার নথি বলছে, সাতাশ বছর আগের সে চুক্তির কপি পুরভবন থেকে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছে অনেক দিন আগে। এমনকী, ডেভেলপার সংস্থার কাছে মূল চুক্তিপত্রের যে কপি থাকার কথা, তা-ও নেই। পুরসভার এক আমলা বলছেন, “গত বছর লেক মল উদ্বোধনের সময় অরুণ প্লাস্টিকের সঙ্গে হওয়া পুরনো চুক্তির কাগজপত্রের খোঁজ পড়েছিল। কোথাও পাওয়া যায়নি। পরে জানা গেল, পুরসভার কপি উধাও। আর ডেভেলপার কোম্পানির কাছে থাকা কপি নাকি পুড়ে গিয়েছে!”
চুক্তিকারী দু’পক্ষের হেফাজতে থাকা চুক্তিপত্রের দু’টো প্রতিলিপি-ই এ ভাবে একসঙ্গে বেপাত্তা হয়ে যাওয়াটা অনেকের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকছে। পুর-সূত্রের খবর, কয়েক জন পুর-অফিসারও ঘটনায় রহস্যের গন্ধ পেয়েছিলেন। তবে শীর্ষকর্তারা নীরব থাকায় ওঁরা বিশেষ উচ্চবাচ্য করার সাহস দেখাননি। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠছে, তা হলে পুরনো কোন চুক্তিপত্রের রেশ টেনে ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন প্রাইভেট লিমিটেডের (যা কিনা অরুণ প্লাস্টিকেরই নামান্তর) সঙ্গে সাপ্লিমেন্টারি চুক্তি হল?
এখানেও অনিয়মের আঁচ। এক পুর-আধিকারিকের বক্তব্য, বছর নয়েক আগে, ২০০৫-এ পুরসভার তদানীন্তন ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার একটি কাগজ ‘সার্টিফাই’ করে জানিয়েছিলেন, সেটাই পুরনো চুক্তির প্রতিলিপি। তারই ভিত্তিতে ভেঙ্কটেশের হাতে লেক মল সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। “ঘটনা হল, এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংক্রান্ত কোনও কাগজকে এ ভাবে মূল নথির প্রতিলিপি হিসেবে সার্টিফাই করার এক্তিয়ার ওঁর ছিল না। তবু সেটা গ্রহণ করা হল কেন, তা নিয়ে সন্দেহ থাকা স্বাভাবিক।” মন্তব্য করেন আধিকারিকটি। প্রসঙ্গত, সংশ্লিষ্ট ওই ইঞ্জিনিয়ার দীর্ঘ কাল কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং দফতরের ডিজি পদে ছিলেন। পুরসভার যুগ্ম কমিশনারের অফিসের খবর, ওঁর বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। বর্তমান পুরবোর্ডের আমলেই ওঁকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এক্তিয়ার-বহির্ভূত কাজেই শেষ নয়। আসল চুক্তির প্রতিলিপি হিসেবে খাড়া করা সতেরো পাতার ওই চুক্তিপত্রে নানা অসঙ্গতিও রয়েছে বলে মত পুরসভার একাধিক আমলার।
কী রকম? ওঁদের দাবি: আসল চুক্তিপত্রটি সম্পাদিত হয়েছিল ১৯৮৭-তে। অথচ ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সার্টিফাই করা প্রতিলিপিতে দেখা যাচ্ছে, সেখানে নোটারির স্বাক্ষর ২০০৩-এর! পুরসভার আইন দফতরের এক অফিসার বলেন, “১৯৮৭-তে সম্পাদিত চুক্তিতে নোটারির সই হবে সে বছরেরই। ষোলো বছর পিছিয়ে যাওয়াটা ঘোরতর সন্দেহজনক।” উপরন্তু একেবারে শেষ পাতায় তত্কালীন পুর-সচিব ও পুর-কমিশনারের সই থাকলেও তাতে তারিখ নেই। এমনকী, দুই অফিসারের কোনও সিলমোহরও নেই!
এ হেন বিবিধ গুরুতর অসঙ্গতিতে ভরা নথিটি নিয়ে পুর-কর্তৃপক্ষ রীতিমতো বিব্রত। তথ্য জানার অধিকার (আরটিআই) আইনে পাঠানো একটি চিঠি ওঁদের অস্বস্তি আরও বাড়িয়েছে। পুরসভার আইন দফতরের খবর, হাইকোর্টের এক আইনজীবী মূল চুক্তিপত্র দেখতে চেয়ে চিঠিটি দিয়েছেন। “চুক্তির কাগজ তো হাপিস! চিঠির কী উত্তর দেওয়া হবে, উপরওয়ালাদের কাছেই জানতে চাইব।” মন্তব্য এক অফিসারের। পুরসভার উপরওয়ালারা কী বলেন? মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, মূল চুক্তিপত্র নিখোঁজ হওয়ার খবর তিনি জানেনই না। “একটা চুক্তি তো দেখেছি!”— বুধবার বলেন তিনি। সেটা যে সার্টিফায়েড কপি, তা শোনার পরে মেয়রের প্রতিক্রিয়া, “তাতেই তো হবে!” স্রেফ ‘সার্টিফায়েড’ কপির ভিত্তিতে এমন একটি প্রকল্প রূপায়ণের নতুন চুক্তি করা যায় কি না, সে সংক্রান্ত আইনি বিষয়ে মেয়র কোনও মন্তব্য করতে চাননি। পদে পদে বিতর্কের ঝুঁকি রেখেও নতুন চুক্তির পথে পুরসভা এগোল কেন?
এক আমলার ব্যাখ্যা, “পুরনো চুক্তিপত্র না-থাকায় নতুন চুক্তি সম্পাদনে আইনত বাধা ছিল। তাই সাপ্লিমেন্টারি চুক্তি, যাতে ব্যাপারটায় খানিকটা হলেও আইনি তকমা দেওয়া যায়। ভেঙ্কটেশকে নতুন ভাবে দায়িত্ব দিতে হলে এমন একটা কিছু করতেই হতো।” মল সংস্কারের দায়িত্বে ভেঙ্কটেশকেই আনার এ হেন মরিয়া তাগিদ প্রসঙ্গে অবশ্য ‘প্রভাবশালীদের পাইয়ে দেওয়া’র তত্ত্বই ঘোরাফেরা করছে পুরভবনের অন্দরে। বস্তুত লেক মল বিতর্ক ফাঁস হতেই, পুজোর ছুটি পড়ার আগের রাতে লিজ-মেয়াদ বিভাজনের নতুন চুক্তিতে তড়িঘড়ি ভেঙ্কটেশ-কর্তাদের সইসাবুদ সেরে ফেলে পুরসভা। তা রেজিস্ট্রেশন করাতে সোমবার ভেঙ্কটেশ-কর্তা শ্রীকান্ত মোহতা পুরভবনে হাজির হয়েছিলেন। অন্য দিকে ভেঙ্কটেশ-চুক্তির জেরে আর্থিক ক্ষতির অভিযোগ তুলে সোমবারই মেয়রকে স্মারকলিপি দিয়েছেন সিপিএম কাউন্সিলরেরা। পুরসভার বিরোধী দলনেত্রী রূপা বাগচির ঘোষণা, “২১ তারিখের পুর-অধিবেশনে বিষয়টি অনুমোদনের জন্য তোলা হবে। সে দিন প্রতিবাদ জানাব।” আন্দোলনে নেমেছে কংগ্রেসও। মঙ্গলবার পুরভবনের সামনে কংগ্রেস কাউন্সিলর প্রকাশ উপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মেয়রের কুশপুতুল দাহ হয়েছে। কাল, শুক্রবার ওখানে বিজেপি’র বিক্ষোভ দেখানোর কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy