ওঁরাই ওঁদের পুজোর মুখ। — নিজস্ব চিত্র।
কলকাতার শারদীয় উৎসবের সঙ্গে ‘লাল রঙের পাড়া’ সোনাগাছির যোগ অনেক দিনের। এ বার যৌনকর্মীদের পুজোর বয়স ১১ বছর। শেষ কয়েক বছর ধরে থিমও ঢুকেছে সোনাগাছির পুজোয়। কিন্তু প্রতি বারই একটা সামাজিক বার্তা দেওয়ার ভাবনা থাকে পুজোর আয়োজক যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির। কিন্তু এ বার নিজেদের কথাই বলতে চান উত্তর কলকাতার দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট, অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট, শেঠবাগান, রামবাগান গলির মেয়েরা। পুজোর থিমে তাই যৌনকর্মীদের সগর্ব ঘোষণা— ‘আমাদের পুজো, আমরাই মুখ।’
কলকাতার পুজোয় বড় কমিটিগুলি থিমের সঙ্গে সঙ্গে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর নিয়োগ করে। অভিনেতা, অভিনেত্রী থেকে মডেলরা সুযোগ পান। সেই দায়িত্বটাও নিজেদের হাতেই রাখতে চাইছেন যৌনকর্মীরা। নিজেরাই মডেল হিসাবে ফোটোশুটে অংশ নিয়েছেন। এ বার দুর্বারের যা পরিকল্পনা তাতে সোনাগাছির পুজোর হোর্ডিং দেখা যাবে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায়। আর সেই হোর্ডিংয়ে দুর্গার সঙ্গে মুখ থাকবে পাড়ার মেয়েদেরই। সেই মেয়েদের মধ্যে রয়েছেন যৌনকর্মী তথা দুর্বারের সম্পাদক বিশাখা লস্কর। তিনি বলেন, ‘‘যত যাই হোক, আমরা উৎসবের দিনেও আলাদাই থাকি। এ বার আমরা ঠিক করেছি, আমরাও অন্যদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকব না। আমরাই হয়ে উঠব পুজোর মুখ। একটি সংস্থার সাহায্যে শুটিংপর্ব মিটে গিয়েছে। হোর্ডিং, ব্যানার তৈরি হচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যেই কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় লাগানো হবে।’’ প্রসঙ্গত, বিশাখা নিজেও মুখ হিসাবে থাকছেন দুর্গাপুজোর হোর্ডিংয়ে।
পুজোর থিমে লড়াইয়ের কথা এই প্রথম বার হলেও এ পাড়ার পুজো নিয়ে অনেক লড়াই চালাতে হয়েছে দুর্বারকে। ২০১৩ সালে প্রথম বার পুজো হয়েছিল। কিন্তু নতুন পুজো হিসাবে অনুমতি নিয়ে সমস্যা হয়। শেষ পর্যন্ত হাই কোর্টের নির্দেশে পুজো করা সম্ভব হলেও আয়োজন হয় একটি ছোট ঘরে। পরের বছরও একই রকম সমস্যা তৈরি হয়। সে বার একেবারে শেষ মুহূর্তে ঘরের ভিতরে পুজোর অনুমতি মেলে। ২০১৫ সালেও পুজোয় বাধা আসায় প্রতিবাদে উৎসবে অংশ নেয়নি সোনাগাছি। পরের বছর ফের পুজোর উদ্যোগী হলেও প্রশাসনিক বাধা আসে। শেষ পর্যন্ত ২০১৭ সালে পাওয়া আদালতের নির্দেশে সোনাগাছিতে দুর্বারের অফিসবাড়ির কাছে মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের উপরে আট বাই কুড়ি ফুটের মণ্ডপে দুর্গাপুজো করার অনুমতি পান তাঁরা।
প্রতি বছর একচালার দুর্গাই আসেন এখানে। তবে ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতির জন্য পুজো হবে কী করে এমন প্রশ্ন তৈরি হয়ে যায়। শেষে পুজোর অধিকার বজায় রাখতে ছোট করেই করা হয়। কারণ, এক বার পুজো বন্ধ হয়ে গেলে যদি আবার অনুমতির সমস্যা হয়! ভয়ে ভয়েই কোনও রকমে পুজো করেছিল দুর্বার। ২০২১ সালে কলকাতার চোরবাগান সর্বজনীনের পক্ষ থেকে মাত্র ১০১ টাকায় দেওয়া হয় মূর্তি। তাতেই পুজো হয়। কারণ, তখনও পর্যন্ত করোনার সময়ে পাড়া ছেড়ে দেওয়া অনেক যৌনকর্মীই ফেরেননি। যাঁরা ফিরেছিলেন তাঁদের রোজগারও তখন খুবই কম ছিল বলে জানালেন দুর্বারের মুখপাত্র মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায়। মহাশ্বেতা বলেন, ‘‘এখন শুধু কলকাতাতেই নয়, দুর্বারের উদ্যোগে বিষ্ণুপুর, দুর্গাপুর, আসানসোল, বসিরহাটের যৌনপল্লিতেও দুর্গাপুজো হয়।’’
তবে কলকাতার অন্য পল্লিতে পুজো হয় না। সোনাগাছির পুজোয় অংশ নেন রামবাগান, শেঠবাগান, রবীন্দ্রসরণি, অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট, পলাতক ক্লাব এলাকায় যত যৌনকর্মী রয়েছেন তাঁরা সকলেই। আবার এই পুজোর ভোগ পৌঁছে যায় কলকাতার নানা প্রান্তে। বৌবাজারের হাড়কাটা গলি, প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট, কালীঘাটের লকার মাঠ, টালিগঞ্জের ইউকে মণ্ডল লেনে। আর রাজারহাট, উল্টোডাঙা, জানবাজার এলাকায় যে সব যৌনকর্মী ঘুরে ঘুরে কাজ করেন তাঁরা অবশ্য সোনাগাছিতেই চলে আসেন।
পুজো নিয়ে রাগ আগেও দেখিয়েছে সোনাগাছি। শাস্ত্র মতে দুর্গাপুজোর জন্য বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা আর দেওয়া হবে না বলেও ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু পুজোর থিমে এ বার যে রাগের প্রকাশ, তা অতীতে দেখা যায়নি। তবে এটাকে রাগ বলতে নারাজ অনেকেই। যৌনকর্মী সুন্দরী জানার বক্তব্য, ‘‘উৎসব তো সবার। সেই উৎসবে সবাই ভাল থাকুন আমরাও চাই। কিন্তু আমদের পুজোর মুখ আসলে তো আমরাই। সেই পরিচয়েই উমা আসেন আমাদের পাড়ায়। সেই কথাটাই আমার এ বার স্পষ্ট করে বলতে চাইছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy