প্রতিবাদীদের গাঁধীগিরি। পুলিশি বাধার মুখে তাঁদের হাতে ফুল দিচ্ছেন বাম বিক্ষোভকারীরা। শুক্রবার মৌলালিতে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
এক দিকে শাসকদলকে কঠোর প্রতিরোধের বার্তা, অন্য দিকে ফুল দিয়ে পুলিশের সঙ্গে গাঁধীগিরি। পুর-যুদ্ধের ময়দানে সিপিএমের দ্বিমুখী কৌশলের সাক্ষী রইল শুক্রবারের কলকাতা।
বৃহস্পতিবার ধর্মতলায় পুলিশের লাঠিতে এসএফআইয়ের বিক্ষোভ সমাবেশ রক্তাক্ত হয়েছে। রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে তাদের ‘আইন অমান্যের’ মিছিল ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করলে পুলিশ বেধড়ক লাঠি চালায়, যাতে বেশ কিছু সদস্য-সমর্থক আহত হন। সেই ‘দমননীতি’র প্রতিবাদে এ দিন বাম ছাত্র সংগঠনগুলি যে অবরোধ বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল, সেখানে পুলিশের হাতে লাল গোলাপ তুলে ‘শান্তির’ আবহ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন বাম ছাত্র নেতারা। আবার এ দিনই বামফ্রন্ট বৈঠকের পরে ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু জানিয়েছেন, পুরভোটে তৃণমূল সন্ত্রাস চালালে তাঁরা সর্বশক্তি দিয়ে রুখবেন। তাঁর ঘোষণা- ‘‘বুথ দখলের চেষ্টা হলে আগুন জ্বলবে। মানুষ মেনে নেবে না। একতরফা কিছু হবে না।’’
বস্তুত পুরভোটের আগে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা করতে ও শাসকদলের উপরে চাপ বজায় রাখতে বাম নেতৃত্ব যে ‘আক্রমণাত্মক’ ভূমিকা আঁকড়ে থাকতে চান, ফ্রন্টের বৈঠকে শরিক নেতাদের বক্তব্যেও তার আঁচ মিলেছে। তাঁরা জানিয়েছেন, কলকাতায় তৃণমূল বুথ দখল করে ভোট করলে পর দিন মহানগর অচল করা হবে। এক শরিক নেতার কথায়, ‘‘কলকাতায় আমরা আত্মসমর্পণ করলে জেলায় বাকি ৯১টি পুরসভায় তৃণমূল একতরফা ভোট করবে। তা হতে দেওয়া যায় না।’’
শুধু কথায় নয়। কাজেও তৃণমূলের সঙ্গে সমানে টক্কর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নেওয়া হচ্ছে ধারাবাহিক বিক্ষোভ-কমর্সূচি। কেন্দ্রের ভূমি-বিলের প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার রাজপথে হাঁটবেন আগামী বুধবার, ৮ এপ্রিল। তার আগের দিন, অর্থাৎ মঙ্গলবার দুপুরে মহাজাতি সদন থেকে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ পর্যন্ত মহামিছিলের ডাক দিয়েছে বামেরা। প্রতিবাদের বিষয় হিসেবে তাতে পুরভোটে তৃণমূলের সন্ত্রাস থেকে শুরু করে গ্রামে বিদ্যুৎ-জলের অভাব, আলুচাষিদের আত্মহত্যা বা এসএসসি, টেট দুর্নীতি— সবই থাকছে। আবার মাস কয়েক আগে শহরে প্রতিবন্ধীদের মিছিলে পুলিশি লাঠিচালনার ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার প্রতিবন্ধীরা আইন-অমান্য করবেন ধমর্তলায়।
সব মিলিয়ে হারানো মাটি যতটা সম্ভব ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে বামেরা ফের পূর্ণ উদ্যমে পথে নামতে চাইছে।
এবং শুক্রবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। বৃহস্পতিবারের লাঠিচার্জের প্রতিবাদে এ দিন কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় পথ অবরোধ করেছিলেন এসএফআই-সহ বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের ছেলেমেয়েরা। মধ্যমগ্রামে পুলিশ লাঠি চালালে ১৩ জন আহত হলেও লক্ষ্যণীয় ছিল এসএফআইয়ের ‘গাঁধীগিরি।’ অনেক জায়গায় বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে বাধাদানের বদলে হাতে তুলে দিয়েছেন লাল গোলাপ। বৃহস্পতিবারের সমাবেশে ছাত্রীদের নিগ্রহের প্রতিবাদস্বরূপ কাল রবিবারও বাম ছাত্রীরা রাজ্যের প্রতিটি থানায় গিয়ে পুলিশকে গোলাপ উপহার দেবেন বলে জানিয়েছেন এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক দেবজ্যোতি দাস। কর্মজীবীদের উদ্দেশে তাঁর আবেদন, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনে পুলিশি নিপীড়নের প্রতিবাদে সোমবার দুপুরে পনেরো মিনিট পেন-ডাউন করুন।’’ সে দিন সন্ধ্যায় পনেরো মিনিট বাড়ি নিষ্প্রদীপ রাখতে অভিভাবকদেরও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী এ দিন কলকাতা ও শহরতলির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়-সহ রাজ্য জু়ড়ে বেলা দেড়টা থেকে নাগাড়ে ঘণ্টাখানেক চলেছে অবরোধ। যার জেরে মধ্যমগ্রামে যশোহর রোডে ও শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে দীর্ঘক্ষণ যানজট হয়। মৌলালিতে যখন বিক্ষোভকারীরা পুলিশের হাতে ফুল দিচ্ছেন, তখন সেখানে আসেন প্রবীণ সিপিএম নেতা শ্যামল চক্রবর্তী। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘যে পুলিশ আজকে অবরোধ তুলতেও এত লাঠি এনেছে, তারা কাল আইন অমান্য সামলাতে খালি হাতে গিয়েছিল, এটা বিশ্বাসযোগ্য?’’
অবরোধের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুতুলও পোড়ানো হয়েছে। কিন্তু এ দিন বাম ছাত্রদের প্রতিবাদের মূল সুরটা বেঁধে দিয়েছিল ‘গাঁধীগিরি’ই। পুলিশের টুপির নীচে গোলাপ ফুল আঁকা পোস্টার বুকে ঝুলিয়ে মোড়ে মোড়ে মানববন্ধন করেছেন প্রতিবাদীরা। মারমুখী পুলিশের আরোগ্য কামনা করে তাতে লেখা ‘গেট ওয়েল সুন।’ তবে অভাবিত ফুলের ঘায়ে বিব্রত হতে দেখা গিয়েছে কিছু পুলিশকর্মীকে।
যেমন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’নম্বর গেটে। ফুল দিতে আসা ছাত্রদের পাশ কাটাতে কানে মোবাইল গুঁজে তখনই কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এক পুলিশ অফিসার। আর এক অফিসার তো গোলাপের তোড়া হাতে আগুয়ান তরুণীর চোখে চোখই রাখলেন না। নাছোড় প্রতিবাদী শেষে আইনরক্ষকের পায়ে ফুল রেখে ক্ষান্ত হলেন।
‘গুড ফ্রাইডে’র ছুটিতে পথে নামা জনতা যানজটে আটকে নাকাল হয়েছেন ঠিকই। তবে এ সব দেখে আমোদও পেয়েছেন বিস্তর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy