আতঙ্কিত: ঘটনার পরে ছেলেকে নিয়ে ইসমত। বুধবার। নিজস্ব চিত্র
দোতলার সিঁড়ি পর্যন্ত নেমে আর এগোতে পারছি না। কোলে এক বছর আট মাসের ছেলে ইমতিয়াজ। প্রবল কাঁদছে। এগোব কী, সিঁড়ির মধ্যে একের পর এক রোগী বসে পড়েছেন। আয়া দিদিদের দেখছি, অনেককেই টেনে নামাতে পারছেন না। আমাদের ওয়ার্ডের রমেনদা এক জনকে কোলে নিয়ে নামতে নামতে বললেন, ‘‘পুড়ে মরবে নাকি? না এগোলে কেউ নিয়ে যাবে না!’’ ওই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, সত্যিই পুড়ে মরতে হবে না তো!
জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই ইমতিয়াজের অস্থিমজ্জায় ক্যানসার ধরা পড়ে। গত মাসে উলুবেড়িয়া থেকে এসে ছেলেকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেছি। রয়েছি তিনতলার হেমাটোলজি বিভাগে। কত দিন ওকে বাঁচাতে পারব, জানি না। তবে বুধবার সকালে যা দেখলাম, তা ক্যানসারের ভয়কেও যেন ছাপিয়ে গেল।
এমনিতে সারা রাত ছেলেটা ঘুমোতে দেয় না। খুব শরীর খারাপ লাগলে ওকে গল্প শোনাতে হয়। মঙ্গলবার রাতেও এ জন্য ঘুম হয়নি। সকালে শুনি ‘আগুন আগুন’ চিৎকার। ছেলেকে বুকে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি নীচ থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। হাসপাতাল জুড়ে লোকজন ছুটছেন। কিছু ক্ষণ আগেও বাথরুমের দিকটায় ঘুরে গিয়েছি। কিছুই চোখে পড়েনি! কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেখি দমকলের গাড়ি ঢুকছে! কী করব? সঙ্গে কী নেব? ভাবতে ভাবতেই সিঁড়ির দিকে এগোলাম। পিছন থেকে ডাকছে সূর্য। বছর পাঁচেকের ওই ছেলেটারও ক্যানসার। ওর বাবাকে দেখা যাচ্ছে না। এক কোলে ইমতিয়াজ আর এক কোলে সূর্যকে নিয়ে দ্রুত হাঁটছি।
দোতলায় হঠাৎই এক মহিলা পা টেনে ধরলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘‘বাঁচা মা। মরে যাব। নিয়ে চল..!’’ দেখেই মনে হচ্ছে প্রবল শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। দু’কোলে দু’টো বাচ্চা। কী করে নেব? কয়েক মিনিট পরে ওই মহিলাকে চাদরে মুড়িয়ে নীচে নামাতে এলেন এক হাসপাতাল কর্মী। একতলায় আসতেই ধোঁয়ায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। পোড়া গন্ধে নিঃশ্বাস নেওয়াও কষ্টকর। কেউ হামাগুড়ি দিয়ে নামছেন, কোথাও এক জনের ট্রলিতে লাফিয়ে উঠছেন আর এক জন। সিঁড়ির কাছে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন এক বয়স্ক মানুষ। পেট ফুলে গিয়েছে তাঁর। কিছুতেই তাঁকে মেঝে থেকে সরানো গেল না। শেষে দমকলের চার জন তাঁকে নিয়ে গেলেন।
এ দিকে ইমতিয়াজ কাঁদতে কাঁদতে নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল। নীচের ওষুধের দোকান থেকে তখন গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, সঙ্গে আগুনের হলকা। কোনওমতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় জরুরি বিভাগে। সেখানেই প্রাথমিক চিকিৎসার পরে সাইকায়াট্রি বিভাগে নিয়ে আসা হয় আমাদের। রাতে সেখানেই রাখা হয়েছে হেমাটোলজি বিভাগের ২৫ জনকে। এঁদের মধ্যে ১০ জন মেয়ে। রয়েছেন সূর্যের বাবা সঞ্জয় চন্দ্রও। সংক্রমণ যাতে না ছড়ায়, তার জন্য ব্যবস্থা হয়েছে আলাদা তোষকের।
ডাক্তারবাবুরা এসে ছেলেকে দেখে গিয়েছেন। ছুটে এসেছে আমার স্বামী হাবিবুর রহমান। এর মধ্যেই শুনলাম এক জন মারা গিয়েছেন। আমরা ঠিক আছি দেখেও হাবিবুরের তাই কান্না থামছে না। বেঁচে যে আছি, আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না। ইমতিয়াজের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তারবাবুরা। ও ভাল হবে কি না জানা নেই, আজ অন্তত নতুন জীবন পেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy