মাঝেরহাট ব্রিজের পাশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে রাস্তা। —নিজস্ব চিত্র।
মাঝেরহাটের জট কাটাতে পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার হরিন্দার রাওকে ফোন করলেন মুখ্যসচিব মলয় দে। সূত্রের খবর, মুখ্যসচিবের অনুরোধে শুক্রবার রেল তাঁদের নিজস্ব বিশেষজ্ঞদের পাঠাবেন মাঝেরহাটে, রাজ্যের প্রস্তাব কতটা বাস্তবায়িত করা সম্ভব তা খতিয়ে দেখতে।
যদিও বৃহস্পতিবার সকালেই রাজ্যের প্রস্তাব মতো মাঝেরহাটে রেল লাইনের উপর লেবেল ক্রসিং বসিয়ে বিকল্প পথের প্রস্তাব আদৌ কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়েই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন হরিন্দার রাও। গতকাল বুধবারই রেলের ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দল মাঝেরহাট সংলগ্ন এলাকা পরিদর্শন করে। খতিয়ে দেখা হয় প্রযুক্তিগত খুঁটিনাটি।
মাঝেরহাট সেতু বিপর্যয়ের পর কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে দক্ষিণ শহরতলির একটি বিস্তীর্ণ এলাকা। বেহালা থেকে ঠাকুরপকুর, তারাতলা থেকে বজবজ, টালিগঞ্জ থেকে হরিদেবপুরের বাসিন্দারা প্রতি দিন নাজেহাল হচ্ছেন। ঠাকুরপুকুরের পর থেকে পৈলান, আমতলা থেকে কাকদ্বীপ, রায়চক এমনকি নূরপুরের বাসিন্দারাও নির্ভরশীল ডায়মন্ড হারবার রোডের এই মাঝেরহাট সেতু উপর।
এই রাস্তা দিয়েই সাগর থেকে মাঝেরহাট ব্রিজের উপর দিয়ে ধর্মতলা, হাওড়া, শিয়ালদহে যাতায়াত করত কয়েক হাজার হাজার গাড়ি। এমনকি ডায়মন্ড হারবার এবং খিদিরপুর বন্দর থেকে পণ্যবাহী লরি গত পাঁচ দশক ধরে এই ব্রিজে দিয়েই যাতায়াত করছে।
হঠাৎ ব্রিজ বিপর্যয়ে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে পরিবহণ ব্যবস্থা। প্রতি দিনের ভোগান্তি তো রয়েইছে, তা ছাড়া চাপ বাড়ছে ‘বিপজ্জনক’ দুর্গাপুর, টালিগঞ্জ, করুণাময়ী এবং ব্রেস ব্রিজের উপরে। এই অবস্থায় মাঝেরহাট খালের উপর দিয়ে দু’টি বিকল্প রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা নেয় রাজ্য প্রশাসন।
এই সমস্যার সমাধানে কী রাস্তা বাতলাচ্ছে রাজ্য:
রাস্তা ১) মাঝেরহাট ব্রিজের পাশ দিয়ে হবে এই রাস্তা। মোমিনপুরের দিক থেকে রেল লাইনের ওপর দিয়ে তারাতলার দিকে চলে যাবে রাস্তাটি। ৭ থেকে ৮ মিটার চওড়া করা হবে। খালের পাঁক তুলে প্রথমে কংক্রিটের স্ল্যাব বসানো হবে। তার উপর দেওয়া হবে হিউম পাইপ। যাতে খালের মাটি বসে না যায়। ওই পাইপের উপরেই তৈরি হবে কালভার্ট।
রাস্তা ২) আর একটি বিকল্প রাস্তা হচ্ছে দুর্গাপুর ব্রিজের কাছে রেল লাইনের উপর দিয়েই। এ ক্ষেত্রেও খালের উপর একই পদ্ধতিতে হিউম পাইপ বসিয়ে কালভার্ট তৈরি করা হবে। আলিপুর থেকে রাস্তা খাল এবং রেল লাইনের উপর দিয়ে নিউ আলিপুরে জি ব্লকে গিয়ে উঠবে। নিউ আলিপুরের দিক থেকে একটি পাঁচিল রয়েছে। সেটি ভেঙে দিলেই নতুন রাস্তা পাবেন দক্ষিণ শহরতলির বাসিন্দারা।
রাস্তা ৩) ভাঙা মাঝেরহাট ব্রিজ জুড়তে একটা ব্রেইল ব্রিজ অস্থায়ী ভাবে জুড়ে দেওয়ারও চিন্তাভাবনা করছে রাজ্য। ফলে ওই ব্রিজ দিয়ে হালকা ওজনের যানবাহন যাতায়াত করতে পারবে।
আরও পড়ুন: সেতু-সমন্বয় অধরাই, বিকল্প রাস্তা আঁধারে
প্রথম দুটি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে গেলে পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে রাজ্য সরকারকে। আর সেই জন্যই রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে দু’টি লেবেল ক্রসিংয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয় রেলকে। আর সেই প্রস্তাব ঘিরেই এ দিন দিনভর চলে চাপান-উতোর।
বৃহস্পতিবার শিয়ালদহ ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজারের অফিস চত্বরে বিসি রায় অডিটোরিয়ামে একটি অনুষ্ঠানে পূর্ব রেলের জিএম হরিন্দার রাও বলেন,“আমরা রাজ্য সরকারের চিঠি পেয়েছি। তাঁরা মাঝেরহাটে একটি লেবেল ক্রসিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু ১৫ দিনের মধ্যে লেবেল ক্রসিং করা সম্ভব কী না আমি জানি না।”
অন্য রাস্তা তৈরি করতে বেগ পেতে হচ্ছে রাজ্য সরকারকে। নিজস্ব চিত্র।
রেল সূত্রে খবর, তাঁদের ইঞ্জিনিয়ররা রাজ্যের এই প্রস্তাবটাকেই কার্যত অবাস্তব বলে মনে করছেন। তাঁরা যুক্তি দিয়েছেন, মাঝেরহাট একটি জংশন স্টেশন। সেখানে এক দিকে শিয়ালদহ-বজবজ শাখার রেল চলে। প্রতি ১২-১৫ মিনিটে আপ ও ডাউন লাইনে ট্রেন চলাচল করে। প্রায় ৮০টি ট্রেন চলাচল করে ওই লাইনে। অন্য দিকে মাঝেরহাট চক্র রেলের সঙ্গে সংযুক্ত। তার পাশাপাশি, কলকাতা বন্দরের সঙ্গে রেলপথের যোগাযোগেরও মূল কেন্দ্র ওই স্টেশন। বন্দরের অধিকাংশ কন্টেনার এই স্টেশনের মাধ্যমেই পরিবহণ করা হয়।
রেল কর্তাদের যুক্তি, প্রথমত ১৫ দিনে লেবেল ক্রসিং তৈরি করা সম্ভব নয়। আর লেবেল ক্রসিং করলে তা রেল চলাচল থেকে শুরু করে বন্দরে পন্য পরিবহন বিঘ্নিত করবে। রেলের এক কর্তা বলেন, “লেবেল ক্রসিং করে শহরের যান চলাচলের সমস্যাও মিটবে না। লেবেল ক্রসিং করলেই সেটা ট্রেন চলাচলের জন্য বিভিন্ন সময়ে বন্ধ করতে হবে। সেটা দিনের ব্যস্ত সময়তেও করতে হবে। মাঝেরহাট ব্রিজে যে পরিমান যান চলাচল করে তা লেবেল ক্রসিংয়ে পাঁচ মিনিটের জন্য আটকালেও ব্যপক যানজটের সৃষ্টি হবে।”
আরও পড়ুন: তদন্তে আনা হল ভিন্ রাজ্যের স্ক্যানার
রেলের অন্য এক আধিকারিক বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী ২০ চাকা বা বড় ট্রাক এবং ট্রেলার কলকাতার সেতুতে ওঠায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তার পর রেলে কন্টেনার পরিবহণেও যদি বিঘ্ন ঘটে তাতে বন্দরের পণ্য পরিবহণও ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
সূত্রের খবর, পূর্ব রেলের এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া শঙ্কিত করে রাজ্য প্রশাসনকে। কারণ রেলের সহযোগিতা ছাড়া ওই বিকল্প রাস্তা করা কার্যত অসম্ভব। আর তা হলে, পুজোর আগে কোনও ভাবেই এই যান জটের বিভীষিকা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনও আশা থাকে না।
সেই পরিস্থিতিতেই তড়িঘড়ি পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজারকে নিজেই ফোন করেন মুখ্যসচিব। রেল সূত্রে খবর, মুখ্যসচিবকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটাও রেলের তরফ থেকে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা তাঁদের বিশেষজ্ঞদের বলেছেন সমস্ত যান্ত্রিক এবং প্রযুক্তিগত খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখতে। কারণ এই প্রস্তাব কার্যকর করতে হলে রেলের ওভারহেড বিদ্যুতের তার থেকে শুরু করে সিগন্যাল ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। সেই পরিস্থিতিতে বিকল্প রাস্তা কত দিনে বানানো সম্ভব তা নিয়ে এবার সংশয়ে খোদ পুর্ত দফতরের আধিকারিকরাও।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
(শহরের প্রতি মুহূর্তের সেরা বাংলা খবর জানতে পড়ুন আমাদের কলকাতা বিভাগ।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy