বিশেষজ্ঞদের দাবি, নতুন সেতু করতে হলে অন্তত তিন বছর সময় লাগবে। —নিজস্ব চিত্র।
মাত্র তিন কোটি টাকা। তার জন্য ১২ মাসের টানাপড়েন। পরিণতি—মাঝেরহাটে সেতুভঙ্গ। ঘটনাচক্রে, সেতুর যে অংশটি ভেঙে পড়েছে সেই অংশটিকেই চিহ্নিত করে সংস্কারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
উপযুক্ত দক্ষতাসম্পন্ন ঠিকাদার সংস্থাগুলি আগ্রহপ্রকাশ না-করায় সেতু সংস্কারের জন্য প্রায় ৭ মাসের মধ্যে ছ’টি দরপত্র আহ্বান করা হয়। শেষে একটি ঠিকাদার সংস্থাকে পাওয়া গিয়েছিল। তারা দর দিয়েছিল ৩ কোটি টাকার কিছু বেশি। কিন্তু দরপত্র চূড়ান্ত হলেও পরের ৫ মাসে তাদের ‘ওয়ার্ক অর্ডার’ দিয়ে উঠতে পারেনি অর্থ দফতর। আমোদ-প্রমোদের মতো নানা ক্ষেত্রে যেখানে অর্থের জোগান ব্যাহত হয় না, তখন এমন আপৎকালীন পরিস্থিতিতে তিন কোটি টাকা সময়মতো কেন বরাদ্দ করা গেল না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনেরই অন্দরে। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, দরপত্র নীতি নিয়েও।
ঘটনার সূত্রপাত ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ। বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষার পরে মাঝেরহাট সেতুর সংস্কারের পরিকল্পনা করে পূর্ত দফতর। পূর্ত দফতরের বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, কালক্ষেপ না করে ওই অংশের ‘এক্সপ্যানশন জয়েন্ট’ এবং ‘আরসিবি গার্ডার’-এর (রিইনফোর্সড্ সিমেন্ট কংক্রিট গার্ডার) সংস্কার করা প্রয়োজন ছিল।
২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪, উদ্বোধন হয়েছিল মাঝেরহাট সেতুর। ৩০ সেপ্টেম্বরের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত খবর।
ওই সময়েই তিন মাসের ব্যবধানে তিনটি দরপত্র আহ্বান করা হয়। সেই প্রক্রিয়ায় সে ভাবে সাড়া না মেলায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে চতুর্থবার দরপত্রের আহ্বান (ফোর্থ কল) করা হয়। তখন দু’টি সংস্থা তাতে অংশগ্রহণ করে। সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়া চলতে চলতে নতুন বছর (২০১৮) চলে আসায় ফেব্রুয়ারি মাসে ফের দরপত্র আহ্বান করে সরকার। সংখ্যার নিরিখে সেটি পঞ্চম বারের আহ্বান হলেও সরকারি ভাবে তাকে ‘ফার্স্ট কল’ বলা হয়। দরপত্র কমিটি সন্তুষ্ট না-হওয়ায় মার্চ মাসে ফের আহ্বান করা হয় দরপত্র। ৩১ মার্চ দরপত্রের শেষ দিন ছিল। ষষ্ঠ দরপত্রে একটি সংস্থাই অংশগ্রহণ করেছিল। সরকারি নিয়মে প্রথম দু’টি আহ্বানে ন্যূনতম তিনটি সংস্থাকে দরপত্র দিতে হয়। তা পাওয়া না-গেলে পরের আহ্বানে একটি সংস্থার দরপত্র মেনে নেওয়া যেতে পারে। সেই নিয়ম মেনেই শেষ ঠিকাদার সংস্থাকে বাছাই করে কমিটি।
আরও পড়ুন: অনেক দিনের ‘ক্লান্তি’ অসহ্য হতেই মাঝেরহাটে এই বিপর্যয়!
আরও পড়ুন: রেলকে খোঁচা মমতার, পাল্টা যুক্তি রেলেরও
এর পরে শুরু হয় দর নিয়ে টানাপড়েন। সরকার নির্ধারিত দর ছিল প্রায় ২ কোটি ৮১ লক্ষ টাকা। ঠিকাদারের দর এর থেকে ৩% পর্যন্ত বেশি হলে দরপত্র কমিটিই তা মঞ্জুর করতে পারে। কিন্তু তার বেশি হলে মঞ্জুরি নির্ভর করে অর্থ দফতরের উপর। এ ক্ষেত্রে ঠিকাদার সংস্থাটি সরকারি দরের থেকে ১৬.৫ শতাংশ বেশি দর দিয়েছিল। দরপত্র কমিটির অনুরোধের পরে ০.৫% দর কমাতে রাজি হয় তারা।
কী করার কথা ছিল
• সেতুর উপরিভাগে ১ ফুট বিটুমিনের আস্তরণ তুলে পিচ
• জল থেকে বাঁচাতে ম্যাস্টিক অ্যাসফল্ট
• সেতুর রিএনফোর্সড্ কংক্রিট গার্ডারের সংস্কার
• সেতুর কাঠামোয় মরচে দূর করা
• খসে যাওয়া কংক্রিটের মেরামত
• কংক্রিটের ফাঁপা অংশ ‘সিল’
সেই দর মঞ্জুরির প্রস্তাব অর্থ দফতরে পাঠায় দরপত্র কমিটি। তা মানতে চায়নি অর্থ দফতর। চলতি মাসের গোড়ায় অর্থ মঞ্জুরির জন্য ফের দরবার করে পূর্ত দফতর। দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘কয়েক বছর আগে বর্ধমানের একটি সেতুর সংস্কারের জন্য ৪০% বেশি দর মঞ্জুর করেছিল অর্থ দফতর। এ ক্ষেত্রে সময় মতো তা হলে হয়ত বিপর্যয় এড়ানো যেত। রোগ ধরা পড়লেও টাকা না-মেলায় চিকিৎসাটাই করা গেল না।’’ যদিও অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘এ নিয়ে যা বলার পূর্ত দফতরই বলতে পারবে।’’
পূর্ত দফতরের বিশেষজ্ঞদের একটি অংশের ব্যাখ্যা, রাস্তা, সেতু, উড়ালপুল বা রেল ওভারব্রিজ (আরওবি) তৈরি এবং মেরামতের জন্য পৃথক পৃথক দক্ষতার প্রয়োজন হয়। সব কাজে সব ঠিকাদারের উপযুক্ত দক্ষতা থাকে না। স্বাভাবিক কারণে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ঠিকাদারদের দরও হয় তুলনায় অনেকটা বেশি। কিন্তু অতীতে দরপত্র নীতিতে সময় সময় বেশ কিছু পরিবর্তন করেছে সরকার। ফলে কোনও কোনও ক্ষেত্রে কম দরের কারণে উপযুক্ত দক্ষতাসম্পন্ন পেশাদার সংস্থা দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে আগ্রহপ্রকাশ করে না। মাঝেরহাট সেতুর সংস্কারের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল বলে দাবি করছে সংশ্লিষ্ট সূত্রটি।
প্রশাসন সূত্রের খবর, পূর্ত দফতরের কর্তাদের কী ভূমিকা ছিল, তার খোঁজখবর শুরু হয়েছে। কিছু দিন আগেও যাঁরা দফতরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এবং সম্প্রতি বদলি হয়েছেন, তাঁদের কয়েক জনের ব্যাখ্যাও তলব করেছে নবান্নের শীর্ষ মহল। এরই মধ্যে প্রশাসনিক রদবদলের জল্পনা দানা বেঁধেছে নবান্নে। তার আঁচ দফতরের মন্ত্রীর চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছবে কি না, জল্পনা হয়েছে তা নিয়েও। এর সুস্পষ্ট জবাব না মিললেও মুখ্যমন্ত্রী যে বিষয়টি হাল্কা ভাবে দেখছেন না, সেই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। তিনি নিজেই বুধবার জানিয়েছেন, ঘটনাটা ছোট করে দেখা হচ্ছে না। পুরোটাই তদন্ত হবে।
তবে ঘটনার দায়দায়িত্বের প্রশ্নে রেলের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশাসনের একটি অংশ একে নজর ঘোরানোর কৌশল বলে মনে করলেও আধিকারিকদের অনেকের দাবি, সব কিছুকে অনুসন্ধানের আওতায় আনার জন্যই বিষয়টির পরিধি বাড়িয়েছেন তিনি। তাই এখনই এমন কোনও ধারণা করা উচিত হবে না। দোষী কাউকে যে নজরের বাইরে রাখা হবে না, সেই ইঙ্গিতও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
পূর্ত দফতর সূত্রের খবর, প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি করেছেন ইঞ্জিনিয়াররা। মুখ্যমন্ত্রীকে তা জানানো হবে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত সেতুর পরিবর্তে নতুন সেতু হবে, না কি ভেঙে পড়া অংশের মেরামত হবে, তা মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, নতুন সেতু করতে হলে অন্তত তিন বছর সময় লাগবে। ক্ষতিগ্রস্ত অংশের মেরামত মাস ছ’য়েকে করা সম্ভব। দফতরেরই এক কর্তার আক্ষেপ, ‘‘জামার একটি অংশ ছিঁড়ে গেলে তৎক্ষণাৎ তা যে রিফু করা জরুরি, এটা বোঝা জরুরি ছিল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy