গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
‘জড়িয়ে ধরেছি, চুমু খেয়েছি, বেশ করেছি। চুমু খেয়েই বাঁচতে চাই।’
দৃশ্য ১: ২০১৪ সাল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চার নম্বর গেট। চার দিকে প্রায় অন্ধকার। রাস্তায় থিকথিকে ভিড়। সেখান থেকে উৎসুক চোখগুলো বার বারই গেটের সামনে উঁকি দিচ্ছে। ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে পরস্পরকে চুমু খাচ্ছে এক দল তরুণ-তরুণী। মুখে স্লোগান—‘আমার শরীর, আমার মন। দূর হটো রাজশাসন’।
দৃশ্য ২: ২০১৪ সাল। কোচির মেরিন ড্রাইভ। শ’য়ে শ’য়ে যুবক-যুবতী একে অপরকে চুমু খাচ্ছে। সঙ্গে মুখরিত স্লোগান। দাবি, নিজের জীবনকে নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার দিতে হবে।
আন্দোলনের নাম ‘কিস অব লভ’।
সুদূর কেরল হোক বা শহর কলকাতা— আন্দোলনের ভাষাটা যেন সব জায়গাতেই এক। হায়দরাবাদ, জেএনইউ, দিল্লি, পুদুচেরি, আইআইটি মাদ্রাজ, আইআইটি বম্বে— দেশের নানা প্রান্ত গর্জে উঠেছে ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর নীতি পুলিশের দখলদারি হঠানোর দাবিতে।
তবে আজ আবার এই প্রতিবাদের প্রসঙ্গ কেন উঠছে? কারণ, ফের এক বার নীতি পুলিশের চোখরাঙানি দেখা গেল। খাস কলকাতাতেই। মেট্রো স্টেশনের জমায়েতের মাঝেই ফের এক বার খসে পড়ল শহরের উদারবাদী মুখোশ। যা নিয়ে এ শহরের গর্বের অন্ত নেই। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে এক দল মানুষ দেখালেন, প্রকাশ্যে ভালবাসার মূল্য চোকাতে হবে।
ঘটনার সূত্রপাত সোমবার রাতের মেট্রোর কামরায়। ভিড়ের হাত থেকে বাঁচতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক যুবক-যুবতী। আর তাতেই অশালীন তকমা এঁটে দিলেন এক দল প্রৌঢ়। প্রকাশ্যেই নাকি অসভ্যতা করেছে ওঁরা! চলন্ত মেট্রোয় শুরু হল চাপা গুঞ্জন। উৎসুক মুখগুলো উঁকি মারতে শুরু করল। কিছু বাঁকা কথাও উড়ে আসতে লাগল। সঙ্গে ফিসফাস। ধীরে ধীরে সেই গুঞ্জন চেহারা নিল বচসার।
শুরুটা এ ভাবেই হলেও শেষটা আরও ভয়ানক চেহারা নিল। দমদম স্টেশনে নামতেই ওই যুগলকে টেনে-হিঁচড়ে এক পাশে নিয়ে গিয়ে চলল বেধড়ক মারধর। ‘অশালীনতার’ যোগ্য শাস্তি দিতেই যেন তার প্রয়োজন ছিল। তবেই না সমাজ পাল্টাবে! কারণ, এ প্রজন্মকে একটা শিক্ষা দেওয়া উচিত বলেই মনে করেন তাঁরা। জনসমক্ষে কী ভাবে আচরণ করতে হয়, এ প্রজন্ম যেন একেবারেই জানে না! অতএব শুধু কথায় কাজ হবে না। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েই সঠিক শিক্ষা দিতে হবে।
গত কালের ঘটনা ফের এক বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, প্রকাশ্যে আবেগ দেখানোটা যেন এখনও অনেকের কাছেই অপরাধের সামিল। আমার-আপনার আবেগের উপরে যেন নীতি পুলিশের লাল চোখ রয়েছে! এ দেশে প্রকাশ্যে ঘুষ নেওয়া, থুতু ফেলা, প্রস্রাব-মলত্যাগ করা— তা-ও যেন আইনের ফাঁক গলে করা যায়। কিন্তু প্রকাশ্যে আলিঙ্গন, আবেগের বহিঃপ্রকাশ— নৈব নৈব চ। আর চুমু? সে তো গর্হিত অপরাধের পর্যায়ে চলে যায় সমাজের একাংশের কাছে।
কিন্তু, আদৌ কি এ অপরাধ? কী বলে আইন? আমরা কি জানি? না জানতেই পারি। বিতর্ক চালাতেই পারি। প্রশ্ন তোলা তো গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু, তাই বলে আইন নিজের হাতে তুলে নেব? নিজেই নিজেকে বানিয়ে ফেলব ‘পুলিশ’! তা-ও আবার নিয়ম নীতির!
এর আগেও এ হেন ‘অপরাধ’-এর শাস্তিতে নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছে নাগরিকদের একাংশ। বিবাহিত মহিলাকে ভালবাসার ‘অপরাধে’ ২০১১ সালে কেরলে বছর ছাব্বিশের এক যুবককে পিটিয়ে খুন করে উত্তেজিত জনতা।
রাতে বাইরে ঘোরার ‘অপরাধ’-এ এক থিয়েটার অভিনেত্রী ও তাঁর বন্ধুকে আটক করে পুলিশ।
২০১৩ সালের জুলাইতে আলাপ্পুঝার সমুদ্র সৈকতে এক যুগলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অভিযোগ ছিল, ওই মহিলা কোনও গয়না পরেননি, অতএব তিনি যে বিবাহিত নন তার প্রমাণ নেই।
২০১৭ সালে কেরলের তিরুঅনন্তপুরমে পার্কে বসে গল্প করার ‘অপরাধ’-এ এক যুগলকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
শুধু প্রকাশ্যে ভালবাসা নয়, কট্টরপন্থীদের নিশানায় উঠে এসেছে ‘লভ জেহাদ’-ও। নানা সময়ে ‘লভ জেহাদে’র হাত থেকে দেশ বাঁচাতে তৎপর হয়েছেন কট্টরপন্থীরা। সম্প্রতি কেরলের হাদিয়া মামলায় সেই বিতর্কিত ‘লভ জেহাদ’ শব্দবন্ধটি আরও প্রচারের আলোয় আসে।
নীতি পুলিশির এমন উদাহরণ রয়েছে ভূরি ভূরি।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রকাশ্যে ভালবাসাই হোক বা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের অন্য ধর্ম গ্রহণ অথবা পছন্দের জীবনসঙ্গী নির্বাচন— প্রতি ক্ষেত্রেই নীতি পুলিশের এই চোখরাঙানি কেন? এখনও রাস্তায় হাত ধরে হাঁটলে বাঁকা কথা ছুড়ে দিতে অভ্যস্ত তেন সমাজের একাংশ। পার্কে বা লেকের ধারে বসে প্রেমিক-প্রেমিকার খুনসুটিও উর্দিধারী আইনরক্ষকেরা চোখরাঙানির মুখে পড়ে। প্রকাশ্যে চুমু খেলে পুলিশকে লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যেতে হবে, এমন কোনও ধারা এ দেশের আইনে নেই। এ নিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশি তৎপরতার নামে ক্ষমতার অপব্যবহারই চলে বলে মনে করেন সমাজের একাংশ। এ নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। কোনটা শালীন, আর কোনটাই বা অশালীন সে তো বরাবরই আপেক্ষিক বিষয়। তার গণ্ডি বেঁধে দিতে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াটা কখনই কাম্য হতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy