তিলোত্তমা মজুমদার
সমাজ পাল্টাচ্ছে, সেটা অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই। আমাদের সমাজ আসলে যে অসুখে ভুগছে তা হল আদ্যন্ত ভণ্ডামি এবং অসততা। হলিউড ফিল্মের কথা বাদই দিলাম, বলিউডের ফিল্মেও দেখি গানের সময় প্রায় একশো ফুট দূর থেকে নায়ক-নায়িকা পরস্পরের দিকে ছুটে আসছে। তারা আলিঙ্গনাবদ্ধ হচ্ছে। এবং এটা আমরা দেখি সপরিবার। তখন কোনও রকম নীতি কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কারণ, প্রেম সুন্দর। দুই পরিণতবয়স্ক মানুষ পরস্পরকে ভালবাসছে, এই দৃশ্যের মধ্যে ‘অনৈতিক’ কিছু থাকার কথাই নয়। কিন্তু বানানো জগৎ এবং বাস্তব যখন কোথাও কোনও বিন্দুতে এসে মেশে, তখন নৈতিকতার দোহাই দিয়ে ভণ্ডামি চোখে পড়ে সবচেয়ে বেশি। যেমন, ফিল্মে বা টেলিভিশনে দেখা কোনও অনুষ্ঠানে কোনও স্বাধীনচিত্ত মেয়ে তার পোশাক, তার ক্রিয়াকর্ম, এমনকী তার সাফল্য-অসাফল্য— সবটাই প্রশংসিত হয় এবং মর্যাদা পায়। কিন্তু, ঠিক সেই সেই পদক্ষেপ যদি বাড়ির মেয়েটি বা বাড়ির বধূটি করতে চায় তখন আর তা সমর্থনযোগ্য থাকে না। সেটা খেলা হতে পারে, মডেলিং হতে পারে, এমনকী, নৃত্যকলা কিংবা নাট্যাভিনয়ও হতে পারে। কিংবা স্রেফ চাকরি করা, সেটিও দেখা যায় কোথাও কোথাও অনৌচিত্যের বিপুল বাধার মুখোমুখি হয়।
যে ঘটনাটি নিয়ে এত শোরগোল সেটি যতখানি নিন্দাজনক ততখানি হাস্যাস্পদ। নিন্দে এই কারণে নয় যে দু’টি ছেলেমেয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করেছিল, নিন্দে এখানে যে এই আলিঙ্গন আপাত-সৌভদ্র ব্যক্তিবর্গের বর্বরতাকে উন্মোচিত করে দেয়। যে কোনও সভ্য দেশ আলিঙ্গন একটি সভ্য ও সুন্দর প্রক্রিয়া বলেই মেনে নেয়। আমাদের দেশেও তা একেবারেই ঘটে না, এ কথা বলা যায় না। বন্ধুত্বপূর্ণ আলিঙ্গন, আত্মীয়তাসুলভ আলিঙ্গন আমাদের রীতিতেও প্রচলিত। আলিঙ্গন মানেই অশালীনতা, যারা এ কথা মনে করে তাদেরই সর্ষের মধ্যে ভূত বসে আছে। হয় তারা বিকৃতমনস্ক, নয় যৌন ঈর্ষাতাড়িত। এদেরই মধ্যে কেউ কেউ ভিড়ের সুযোগে অশালীন ভাবে নারী অঙ্গ স্পর্শ করে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সমস্ত সম্পর্ককে বিকৃত যৌনতার দৃষ্টিতে কতিপয় ব্যক্তি বিচার করে বলেই দিল্লির নির্ভয়া-কাণ্ড ঘটে, কাঠুয়া বা উন্নাওয়ের মতো নৃশংস ঘটনা ঘটে।
আমার দৃষ্টিতে আজকের যে যুবক-যুবতীরা বা তরুণ-তরুণীরা পথ চলার সময় পরস্পরের কাঁধে হাত রাখার সাহস পায়, যে যুবক-যুবতীটি আলিঙ্গনের ভেতর দিয়ে ভালবাসার উত্তাপকে সম্মানিত করার সাহস দেখিয়েছে, তারা সকলেই অভিবাদনযোগ্য। অকারণ নিষেধ এবং শালীনতার ভ্রান্ত সংজ্ঞা থেকে সমাজকে মুক্ত করবার পথে তারা একনিষ্ঠ সৈনিক।
দমদম মেট্রো স্টেশনে নামিয়ে পেটানো হল যুগলকে। সোমবার রাতে।
যে সমাজ সাহিত্যে যৌনতার প্রসঙ্গকে চোখ রাঙায়, ফিল্ম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, প্রেমিক যুগলের উপর চড়াও হয় পুলিশ এবং নীতি পুলিশের দল, যে সমাজে জীবনসঙ্গী স্বেচ্ছায় নির্বাচন করলে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটিয়ে ফেলা হয় এবং যার নাম দেওয়া হয় ‘অনার কিলিং’, সেই সমাজ ভয়ঙ্কর এবং বিশ্বস্ত নয়। আজ একটি আলিঙ্গন দেখে যারা মারমুখী, কাল তারাই কোনও শিশুধর্ষণ করে, মেরে ফেলবে নিজের সন্তানকে, তার স্বেচ্ছা নির্বাচনের জন্য, এমনকী, এই পিছু হঠতে থাকা মানুষের দল মেয়েদের আবার চিকের আড়ালে পাঠাবার ষড়যন্ত্র শুরু করলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
সভ্য ও বিবেকবান মানুষ শালীনতার অর্থ বোঝে। তার মধ্যেই প্রেম ও সুন্দর তার ভাষ্য রচনা করে। বিগত দিনে করেছে, যা নিয়ে রচিত হয়েছে মহাকাব্য কিংবা মহান সাহিত্য, ভবিষ্যতেও ভালবাসা তার নিজস্ব সৌন্দর্যে প্রবাহিত হয়ে চলবে। যারা ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং একান্ত জগৎকে অশালীন আক্রমণ করে তাদের সমুচিত জবাব দিতে পারে নব্য প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরাই। তাদের সমর্থন করাই আমাদের প্রতিজ্ঞা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy