Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

মডেল হওয়ায় ‘বাধা’ পরিচয়! চাওয়ালা বাবাকে ছেড়ে গেল মেয়ে

ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত বারোটা। রবীন্দ্র সরণির এক হাসপাতালের সামনে চায়ের দোকানে সময় কাটে তাঁর। টানাটানির সংসারে তিনিই একমাত্র রোজগেরে। স্বপ্ন, চায়ের দোকান চালিয়েই দুই মেয়ের এক জনকে ডাক্তার বানাবেন, অন্য জনকে উকিল!

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৮ ০৩:০১
Share: Save:

ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত বারোটা। রবীন্দ্র সরণির এক হাসপাতালের সামনে চায়ের দোকানে সময় কাটে তাঁর। টানাটানির সংসারে তিনিই একমাত্র রোজগেরে। স্বপ্ন, চায়ের দোকান চালিয়েই দুই মেয়ের এক জনকে ডাক্তার বানাবেন, অন্য জনকে উকিল!

হঠাৎই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে সেই ব্যক্তির। বড় মেয়ে জানিয়ে দিয়েছে, চা বিক্রেতা বাবার পরিচয় নিয়ে পরিবারের সঙ্গে থাকতে চায় না সে। মুম্বই গিয়ে মডেল হতে চায়। কলকাতায় ‘চাওয়ালার’ মেয়ে হিসেবে সেই কাজ না কি অসম্ভব! তাই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে ওই কিশোরী।

আপাতত সরকারি হোমে ঠাঁই হয়েছে বছর সতেরোর সেই কিশোরীর। তাকে পালাতে সাহায্য করার অভিযোগে অপহরণের ধারায় গ্রেফতার হয়েছে কিশোরীর বন্ধু, বছর বাইশের রাজা সোনকার নামে এক যুবক। তদন্ত চালাচ্ছে পোস্তা থানার পুলিশ।

আরও পড়ুন: চতুর্থী থেকেই কি পুজোর সূচি? দুই মতে ভাগ মেট্রো

পুলিশ সূত্রের খবর, তারকেশ্বর যাবে বলে গত ১৮ তারিখ বাড়ি থেকে বেরোয় কিশোরী। ওই রাতেই তার ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু গোটা রাত মেয়ের খোঁজ না পেয়ে একের পর এক ফোন করতে থাকেন বাড়ির লোকজন। পরদিন সকালে কিশোরী নিজেই বাড়িতে ফোন করে জানায়, আর ফিরবে না সে। বলে, ‘মুম্বই চললাম। মডেলিং করব। চাওয়ালার মেয়ে হিসেবে এখানে কিছুই হবে না।’ জানায়, রাজা নামের ওই যুবক তার সঙ্গে রয়েছে। কিশোরীর পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নামে পুলিশ। যদিও ১৯ তারিখ রাজা ফোন করে কিশোরীর মা আর বোনকে বাইপাসের একটি শপিং মলে দেখা করতে বলে। সঙ্গে ছিল ওই কিশোরী। অভিযোগ, বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য মা জোর করলে সেখানেই ফিনাইল খেয়ে আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে ওই যুবকের সঙ্গে পালায় একাদশ শ্রেণির ছাত্রী ওই কিশোরী।

দু’দিন কোনও খোঁজ না পেয়ে পুলিশ এর পরে রাজার পরিবারের লোকজনকে আটক করে। চাপে পড়ে ধরা দেয় রাজা আর ওই কিশোরী। প্রথমে পুলিশের মনে হয়, রাজা বিয়ে করবে বলে কিশোরীকে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পুলিশের সামনে দু’জনেই সেই তত্ত্ব খারিজ করে দেয়। তাদের দাবি, প্রেম বা বিয়ে নয়, কিশোরী মডেল হতে চায়। সেই ‘স্বপ্ন’ পূরণে রাজা সাহায্য করছে মাত্র। পুলিশের অনুমান, রাজাই ওই কিশোরীকে মুম্বইয়ে মডেলিংয়ের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এই চক্রে আরও অনেকে জড়িত থাকতে পারে। গ্রেফতার করে রাজাকে গত ২৩ তারিখ ব্যাঙ্কশাল আদালতে তোলা হলে পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক। কিশোরীকে হোমে রেখে মেডিক্যাল পরীক্ষারও নির্দেশ দেওয়া হয়। শুক্রবারই কিশোরীর গোপন জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে আদালতে।

এ দিন রবীন্দ্র সরণিতে ওই কিশোরীর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, শরিকি বাড়ির চারতলার ছোট ঘরে বাবা-মা আর বোনের সঙ্গে থাকত সে। একটা ছোট খাট ছাড়া
আর কোনও আসবাব নেই সেই ঘরে। তারই মধ্যে দেওয়াল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে মেয়ের মডেল হওয়ার স্বপ্ন। রকমারি আধুনিক পোশাক, নানা ধরনের সাজে তার ছবি
ঝুলছে ঘর জুড়ে।

কিশোরীর মা বললেন, ‘‘চায়ের দোকানের রোজগারে কোনওমতে আমাদের সংসার চলে। তাতেই দুই মেয়ের পড়াশোনা। মাধ্যমিক দেওয়ার পরেই ওর মাথায় যে কী ভূত চাপল, মডেলিং মডেলিং করে লাফাতে শুরু করল! গত এক মাস অনেক রাত করে বাড়ি ফিরত। প্রায়ই নতুন পোশাক কিনছিল। এত টাকা কোথা থেকে পাচ্ছে, তা জানতে চাইলে উত্তর দিত না।’’ মেয়ে কোথায় গিয়েছে? চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন শুনেই কেঁদে ফেলেন কিশোরীর বাবা। বললেন, ‘‘আমি তো চাওয়ালা। আমার কথা বললে না কি ওর বন্ধুরা মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। মডেলিং তো এখানে থেকেও করা যায়। আসলে আমার মেয়ে আমাকেই আর সহ্য করতে পারছে না।’’ চা বিক্রেতা বাবা বলে চলেন, মেয়েকে পড়াশোনা শিখিয়ে ডাক্তার করতে চাওয়ার স্বপ্ন ভাঙার এমনই নানা কথা।

বিশিষ্টেরা অবশ্য মনে করছেন, এই সমস্যা অনেক গভীরে। ওই কিশোরীর ভাবনা-চিন্তায় প্রভাব ফেলছে সমাজে সম্মান না পাওয়ার আশঙ্কা। তা তৈরি হয়েছে বেড়ে ওঠার সময়ে চারপাশের নানা আচরণ ও অভিজ্ঞতা থেকেই। তবে যে পথে কিশোরী চলছিল, তাতে আর একটু এগোলেই সে বড় ধরনের বিপদে পড়তে পারত বলে আশঙ্কা তাঁদের।

অন্য বিষয়গুলি:

Identity Tea Seller Modelling
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE