জল-যাত্রা। এ ভাবেই যাতায়াত চিনার পার্কে।
দু’পাশের টইটম্বুর খাল আর বেহাল নিকাশি ব্যবস্থা। ফলে স্বল্প বৃষ্টিতেই যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জল দাঁড়িয়ে যায়, অতিবৃষ্টিতে সেখানে যা হওয়ার তা-ই হল। শনিবার জলমগ্ন রইল রাজ্যের গর্বের মুখ পাঁচ নম্বর সেক্টর থেকে শুরু করে গোটা সল্টলেক। জল জমে রাজারহাট-গোপালপুর এলাকাতেও। হলদিরাম, চিনার পার্ক, বাগুইআটি-সহ বিভিন্ন এলাকা ছিল জলের তলায়। এ দিন হাঁটুজল ছিল মুক্তারামবাবু স্ট্রিট, কাঁকুড়গাছি, উল্টোডাঙা আন্ডারপাসে। এ ছাড়া, জল দাঁড়ায় দরগা রোড, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড, কোলবার্থ রোড, দমদম রোডেও। ফলে শুক্রবার রাত থেকে চলা বৃষ্টিতে কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন।
মূল সল্টলেকের অফিসপাড়াই শুধু নয়, যেখানে সাধারণত জল জমে না সেই ১ ও ২ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন ব্লকেও জল দাঁড়িয়েছে বলে অভিযোগ। পাশাপাশি, ৩ নম্বর সেক্টর থেকে শুরু করে দত্তাবাদ এবং সংযুক্ত এলাকা কার্যত বানভাসি চেহারা নিয়েছে। কিন্তু অভিযোগ, এত কিছুর পরেও হুঁশ ফিরছে না সল্টলেকের। প্রশাসনের গড়িমসি আর অপদার্থতার ফলেই সল্টলেকের এই অবস্থা বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের।
ভূমির ঢাল অনুসারে সল্টলেকের ১ ও ২ নম্বর সেক্টরের জল স্বাভাবিক নিয়মেই জমা হয় কেষ্টপুর খালে। ৩, ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের জল পাম্পের সাহায্যে ইর্স্টান ড্রেনেজ চ্যানেলে গিয়ে জমা হয়। বাসিন্দাদের অভিযোগ, আগেও অতিবৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়েছে এলাকা। কিন্তু এ ভাবে জল জমে থাকত না। এ দিনের ভোগান্তির জন্য সল্টলেকের প্রাক্তন তৃণমূল পুরবোর্ড ও রাজ্য প্রশাসনকেই দায়ী করছেন বাসিন্দারা।
প্রশাসনের একটি মহলের দাবি, জল জমার বড় কারণ দু’দিকের খালের বেহাল দশা। এক দিকে কেষ্টপুর, অন্য দিকে ইস্টার্ন ড্রেনেজ চ্যানেলে সংস্কার হয়নি। আর এ বছর যে হারে বৃষ্টি হয়েছে, তাতে ইতিমধ্যেই খাল জলে ভরে রয়েছে। তা জল টানতে পারছে না। ফলে তার দু’দিকের বিস্তীর্ণ এলাকা, বিশেষত পাঁচ নম্বর সেক্টরে জল সরানো যাচ্ছে না। শুক্রবারের বৃষ্টির পরে শনিবার সকাল থেকে নবদিগন্ত শিল্পনগরী-কর্তৃপক্ষ কর্মীদের রাস্তায় নামান। চালানো হয় পাম্প। কিন্তু তাতেও সরানো যায়নি জল। শনিবার পাঁচ নম্বর সেক্টরে বহু জায়গায় ছিল কোমর-জল। অনেক বাসও ঢুকতে পারেনি। আইটি কর্মীদের একাংশের অভিযোগ, রাজ্যের মুখ দেখানো হয় এই তথ্যপ্রযুক্তি তালুককে। অথচ বৃষ্টিতে তা-ই জলমগ্ন হয়ে পড়ে। রাজ্য প্রশাসন আর কবে ভাববে? এ দিকে, কেষ্টপুর খালের তলা দিয়ে রাজারহাট-নিউ টাউন জলপ্রকল্পের জন্য পাইপলাইন পাতা-সহ একাধিক কাজ হওয়ায় তার সংস্কারের কাজ পিছিয়ে গিয়েছে বলে নগরোন্নয়ন দফতর সূত্রে খবর। সেই খালও জলে টইটম্বুর। প্রশাসনের একটি মহলের আশঙ্কা, বৃষ্টি একই হারে চললে সল্টলেক থেকে জল বার করা এক কথায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
আঙুল উঠেছে তৃণমূল পরিচালিত প্রাক্তন বিধাননগর পুরসভার দিকেও। পুরসভা সূত্রে খবর, নিকাশির হাল ফেরাতে পুরসভা রাজ্যের কাছে প্রস্তাব পাঠায়। সেই মতো ড্রেনেজ পাম্পিং স্টেশনের সংস্কার-সহ নানা কাজে কোটি কোটি টাকাও বরাদ্দ করে রাজ্য সরকার। কিন্তু অভিযোগ, সেই পরিকল্পনার একটি অংশের কাজ হলেও বাকি অংশের জন্য এখনও টেন্ডারই ডাকা যায়নি। ফলে টাকা এসে গেলেও হাল ফেরেনি নিকাশি ব্যবস্থার।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, সল্টলেকে নিকাশি পরিকাঠামো বহু পুরনো। তা সত্ত্বেও এ বছরের মতো এমন জল আগে কখনও জমেনি। শনিবার খোদ প্রাক্তন চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তীকেও দলবল নিয়ে জল সরাতে পথে নামতে হয়। পরে তিনি বলেন, ‘‘খাল জলে ভরে রয়েছে। ফলে সময় লাগছে।’’ ৫ বছরেও কেন নিকাশি ব্যবস্থার সংস্কার করা যায়নি, তার জবাবে তিনি বলেন, ‘‘প্রকল্পের টাকা সরকার দিয়েছে। একটি অংশের কাজও হয়েছে। কিন্তু কিছু প্রতিবন্ধকতায় সাময়িক কাজ আটকে রয়েছে। তা-ও দ্রুত শেষ করা হবে।’’
জল ঠেলে বাড়ির পথে। মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট ধরে।
পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘বৃষ্টি বেশি হয়েছে। দু’টি খালও জলে ভরে রয়েছে। দ্রুত জল নামানোর চেষ্টা চলছে।’’ নিকাশির বেহাল দশা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘কারিগরি সংক্রান্ত কিছু কারণে নিকাশি প্রকল্পের কাজ শেষ করা যায়নি। পুর-প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রয়োজনে কেএমডিএ-র আধিকারিকদের নিয়ে ওই প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করা হবে।’’
দিন পনেরো আগে যে ভাবে ভারী বৃষ্টিতে ভেসেছিল বিধাননগর কর্পোরেশনের রাজারহাট-গোপালপুর এলাকা, শনিবারও কার্যত তারই প্রতিচ্ছবি দেখা গেল। এ দিন হলদিরাম, চিনারপার্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা জলে ডুবে যায়। জলমগ্ন হয় বাগুইআটি, সাহাপাড়া, শাস্ত্রীবাগান, অর্জুনপুরের মতো বিস্তীর্ণ এলাকাও। উত্তর ২৪ পরগনার জেলা শাসক মনমিত চন্দ জানান, বিভিন্ন জায়গায় পাম্প বসিয়ে জল নামানোর চেষ্টা হচ্ছে। তবে আবাসিক এলাকাগুলিতে রাতেও রয়েছে হাঁটুজল। এ দিন হিডকো ও বিধাননগর কর্পোরেশন-সহ জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরের আধিকারিকেরা চিনার পার্ক ও হলদিরাম এলাকা পরিদর্শন করেন। ছিলেন রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী তথা স্থানীয় বিধায়ক পূর্ণেন্দু বসু ও রাজ্যসভার সাংসদ দোলা সেনও। পর্যবেক্ষণের পরে জেলা প্রশাসন জানায়, ওই এলাকায় বাঁধানো নর্দমার উপরে জবরদখল করে লোকজন বসে পড়েছে। তাই তা পরিষ্কার করা যাচ্ছে না। ওই জবরদখল তুলে দেওয়া হবে বলে জানান জেলা শাসক। একই সঙ্গে প্রশাসনের তরফে স্থানীয় বেশ কিছু আবাসনের কাছে অনুরোধ করা হয়, সেখানকার জমা জল যেন ভিআইপি রোডে ফেলা না হয়। একই অনুরোধ করা হয় বিমানবন্দর-কর্তৃপক্ষকেও। তাতে আগামীকাল থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে দাবি জেলা প্রশাসনের।
শনিবার ছবিগুলি তুলেছেন সুমন বল্লভ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy