ট্রেন তখন গঙ্গার নীচে। — নিজস্ব চিত্র।
এক ডুবেই গঙ্গা এ পার-ও পার করার অভিজ্ঞতাও যে হবে, বড় হওয়া ইস্তক ভাবিনি কখনও। মফস্সলের ছেলে হলেও সাঁতার শেখা নেই। ফলে আমার কাছে দিঘিও ইংলিশ চ্যানেলের সমান। তবু গঙ্গায় ডুব দিয়ে পারাপার করিয়ে দিল কলকাতা মেট্রো।
বৃহস্পতিবার পাতালে প্রবেশ করেছিলাম হাওড়া ময়দানে। মেট্রোর লাইন বেয়ে হাওড়া স্টেশনের তলা দিয়ে গঙ্গারও নীচে। তার পরে নির্মীয়মাণ মহাকরণ স্টেশন হয়ে এসপ্ল্যানেড। সেই স্টেশনও তৈরির কাজ চলছে। কিছু ক্ষণ থেমে আবার উল্টো পথে। আবার গঙ্গার তলা দিয়ে হাওড়া ময়দান। প্রথম দিনের যাত্রায় দশ আর দশ কুড়ি মিনিটের পথ (৪.৮ কিলোমিটার) যেতে-আসতে লাগল ঘণ্টা দেড়েক। মাটির নীচে, জলেরও ৩৩ মিটার নীচে গিয়ে মনে ছিল না বাইরের উত্তাপের কথা। হাওড়া ময়দানে ডাঙায় ওঠার পরে ৪২ ডিগ্রির গরম গায়ে ছ্যাঁকা দিলেও মন বলল, এ তো নতুন দিনের গনগনে রোদ! দেশের প্রথম মেট্রো রেল পাওয়া কলকাতার মুকুটে আরও একটা পালক জায়গা করে নিল। দেশে প্রথম কোনও শহরে নদীর তলা দিয়ে যাবে মেট্রো রেল। আনুষ্ঠানিক প্রথম যাত্রা হয়ে গেল।
কলকাতায় প্রথম যখন মাটির তলা দিয়ে মেট্রো চলা শুরু হয়, তখন কিশোর বয়সে শুধু অবাক হয়েছিলাম। চড়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে। কলকাতায় মেট্রো রেলের পরিকল্পনার সঙ্গে বিধানচন্দ্র রায় থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— অনেক মুখ্যমন্ত্রীর নাম জড়িয়ে। আবার দেশের বিচারে ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে নরেন্দ্র মোদী জমানা। অনেক বদলের সাক্ষী হতে হতে কলকাতা মেট্রোও বদলেছে। উত্তর শহরতলি, দক্ষিণ শহরতলিতে পৌঁছেছে। এ বার গঙ্গা টপকে হাওড়ায়।
কথা ছিল হাওড়া ময়দান থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর ঠিক ১২টায় ছাড়বে ট্রেন। হর্ন বাজল ১২টা ১০ মিনিটে। ঠিক তিন বার। এ দিনের জন্য ট্রেনে ঘোষণার ব্যবস্থা ছিল। ১২টা ১৩ মিনিটে ট্রেন ঠিক বঙ্কিম সেতুর নীচে। এক মিনিট পরেই হাওড়া স্টেশনের তলায়। এখানে যে স্টেশনটা তৈরি হচ্ছে, তার নাম হবে ‘হাওড়া মেট্রো’। ঠিক উপরেই প্রাচীন ইতিহাসের বাস। দেশের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম রেলওয়ে কমপ্লেক্স। এই স্টেশন থেকেই ১৮৫৪ সালের ১৫ অগস্ট প্রথম ট্রেন ছেড়েছিল এই রাজ্যে। গিয়েছিল হুগলি পর্যন্ত। এখন দেশের ব্যস্ততম স্টেশনের অন্যতম হাওড়া দিয়ে রোজ লাখ দশেক মানুষ যাতায়াত করেন। এ বার সেই যাত্রীরা স্টেশন থেকেই মেট্রোয় চেপে কলকাতা আসতে পারবেন। সূচনার দিনে অবশ্য ট্রেন সেখানে না দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল গঙ্গার দিকে। ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক ১২টা ১৬ মিনিট ২৬ সেকেন্ড। ট্রেনের ভিতরে ঘোষণা— ‘আমরা এখন গঙ্গার নীচে প্রবেশ করছি’।
এমনিতে ৪৫ সেকেন্ড লাগার কথা নদীর তলার ৫২০ মিটারের সুড়ঙ্গ পার হতে। তবে মহড়ার ট্রেন চলল কিছুটা গদাইলস্করি চালে। সংবাদমাধ্যমকে ছবি তোলার সুযোগ করে দিতেই মিনিট তিনেক সময় নিল নদীর নীচ দিয়ে চলা প্রথম মেট্রো। মাঝখানে একবার কিছু ক্ষণের জন্য থেমেও রইল। কারণ নিয়ে শোনা গেল রসিকতাও— ‘‘গঙ্গায় মনে হয় জোয়ার এসেছে।’’
রেল বলছে খুব বেশি সময় লাগবে না যাত্রী পরিষেবা শুরু হতে। এ বছরের শেষে না হলেও ২০২৪ সালের গোড়ায় চালু হয়ে যাবে এসপ্ল্যানেড থেকে হাওড়া স্টেশন হয়ে ময়দানে যাওয়ার মেট্রো। এখন অফিসপাড়া থেকে হাওড়া যাতায়াতের মূল পথ রবীন্দ্র সেতু (হাওড়া ব্রিজ)। কেউ কেউ লঞ্চেও যান। লঞ্চে তো বটেই, হাওড়া ব্রিজ পার হওয়ার সময়েও অনেকেরই হাত কপাল ছোঁয় নদীকে প্রণাম জানাতে।
কিন্তু মেট্রোয় চেপে গঙ্গাদর্শন হবে না। এ দিন গঙ্গা পার হওয়া ঘোষণায় বোঝা গিয়েছে! কিন্তু সাধারণ যাত্রার দিন কী হবে! প্রশ্ন শুনে এক রেলকর্মী বললেন, ‘‘জানলার দিকে তাকিয়ে থাকলে দেখা যাবে টানেলের গায়ে নদী শুরু হওয়ার বোর্ড রয়েছে।’’ মনে হল, ঘোষণাটা চালু থাকলেই ভাল হয়। আরও ভাল হয় যদি বলা হয়, ‘‘আপনারা এখন জলস্তরের ৩৩ মিটার নীচ দিয়ে যাচ্ছেন।’’ যেমন বিমানে উচ্চতার কথা ঘোষণা করেন বিমানচালক।
তবে আক্ষেপ একটা থেকেই গেল। গঙ্গা পারাপার করেও গঙ্গাদর্শনের সুযোগ হল না এই মেট্রোয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy