কিছু ঐশ্বর্য চোখ ধাঁধাতে মেলে ধরতে হয়। কিছু ঐশ্বর্য গোপন কুঠুরিতে থাকলেও জৌলুস ঠিকরে পড়ে। সাত রাজার ধন মানিকের সেই সম্পদ টেবিলের নীচে লুকোনো প্যাকেটে মুড়ে রেখেছেন স্টলকর্তা শুভাশিস ভট্টাচার্য। ফার্সিতে লেখা বাদশা আকবরের আমলের কাহিনি ‘তুতিনামা’র বাংলা তর্জমা, চণ্ডীচরণ মুনশির লেখা ‘তোতা ইতিহাস’ খুলে বার করলেন তিনি। পাতা উল্টোতেই হাতছানি দেয় ঝরঝরে ছাপা সুছাঁদ অক্ষরকুল। লেখা আছে, ‘লন্দন রাজধানিতে চাপা হইল ১৮২৫’! ১৪০ পাতার বইয়ের শেষ পৃষ্ঠাতেও ইংরেজিতে লেখা লন্ডন, প্রিন্টেড বাই কক্স অ্যান্ড বেলিস, গ্রেট কুইন স্ট্রিট, লিঙ্কনস ইন ফিল্ড।
বইমেলায় দুষ্প্রাপ্য বইয়ের ঠিকানা সবুজপত্রের স্টলের বইটিতে মিশে আছে বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক আশ্রয়ের ত্রিধারা! ফার্সি, বাঙালি এবং বিলিতি ইংরেজের ছোঁয়াচ। ১৪ শতকের বিখ্যাত ফার্সি বই বাংলায় ভাষান্তর করেন ফোর্ট উইলিয়ামের ফার্সিবিদ মুনশি চণ্ডীচরণ। এবং বইটি ছাপা হয় খাস বিলেতে। বইটির কথা শুনে চমৎকৃত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস’-এর অধিকর্তা, অধ্যাপক অভিজিৎ গুপ্ত। তিনি বলছেন, ‘‘এ বইয়ের দু’-একটি কপি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এবং ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে থাকার কথা। এ ছাড়া আর কোথাও এ বই আছে, কে জানত!’’
অভিজিতের মতে, ফোর্ট উইলিয়ামের গড়ের ইংরেজ রাজপুরুষদের বাংলা শেখানো ছাড়া বিলেতেও সম্ভবত বাংলা বইয়ের কিছুটা বাজার তৈরি হয়েছিল। তা না হলে লন্ডনে বাংলা বই ছাপা হবে কেন? তোতা ইতিহাস প্রথম ছাপা হয় শ্রীরামপুরে ১৮০৫-এ। ১৮২২-এও তা লন্ডনে ছাপা হয়েছিল। ১৮২৫-এর ‘তোতা ইতিহাস’ বিলেতে ছাপা প্রথম তিন-চারটি বাংলা বইয়ের অন্যতম। ইতিমধ্যে সাগ্নিক বুকসের স্টলে এসে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিতে ভরা এডওয়ার্ড ফিটজ়েরাল্ডের ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত কিনে নিয়ে গেলেন সুপ্রিম কোর্টের দিল্লিবাসী আইনজীবী। লক্ষ টাকা খসিয়েও তাঁর মুখের হাসিটি চওড়া। সবুজপত্রের শুভাশিসের সংগ্রহেও হুতোম পেঁচার নকশার ১৮৬২ সালের সংস্করণ। দর্জিপাড়ার রাম প্রেস বসু কোম্পানি কর্তৃক প্রচারিত এই বইটি সম্ভবত হুতোমের নকশার পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ। কয়েক মাস আগে প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। পুরনো বইয়ের বিপুল দাম নিয়ে নানা রসিকতা চলে বইমেলার মাঠে।
ডাকসাইটে বইরসিকেরা অনেকেই জীবনের পরপারে। কারও পুরনো বাড়ির চিহ্নটিও ধুলোয় মিশেছে। বইমেলার মাঠে তাঁদের বইয়েরও নবজন্ম ঘটছে। ১৭২৭-এর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পুব এশিয়া বিষয়ক ভ্রমণকাহিনি ‘অ্যাকাউন্ট অব দি ইস্ট ইন্ডিজ়’-এর গায়ে সুলেখিকা, আগ্রাসী পাঠিকা কল্যাণী দত্তের নামের আদ্যক্ষর ‘কেডি’। কালীঘাট এলাকায় কল্যাণীর বাড়ির এমন কত বই এখন অনাথ হয়ে বইমেলায় নতুন ভালবাসার খোঁজে। সুবর্ণরেখার তুষার মজুমদার সম্প্রতি ১৮ শতকের একটি বইয়ের খবর পেয়ে তা হস্তগত করতে খুলনা চলে গিয়েছিলেন। নন্দকুমারের ফাঁসির সমর্থনে সাহেবদের লেখা বই, তখনকার গুরুত্বপূর্ণ দলিল। সাগ্নিকের আদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলছিলেন, সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমসাময়িক গুরুদাস সরকারের সংগ্রহের বই কেনার কাহিনি। নিজে লক্ষাধিক টাকার বই কেনার সুবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সই করা একটি বই ‘ফাউ’ হিসেবে পেয়ে যান। জার্মান শিল্পী ওয়াইলি জেক্লের আঁকা বুদ্ধের নানা ছবির শতাধিক বছরের পুরনো একটি বইও এ বার এনেছেন আদিত্য। জার্মানি থিমের বইমেলায় তাতেও চিরন্তন জার্মান ছোঁয়াচ।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)