মঙ্গলবার নন্দন-৩ প্রেক্ষাগৃহে সমাবর্তন অনুষ্ঠান। এ বার তা নামমাত্র, পড়ুয়াহীন। নিজস্ব চিত্র।
অনুষ্ঠানটি পড়ুয়াদেরই। পড়ুয়াদের সাফল্যের স্বীকৃতি দেওয়ার অনুষ্ঠান। কিন্তু এক জনও পড়ুয়া উপস্থিত নেই!
পৌরোহিত্য করার কথা আচার্য-রাজ্যপালের। অথচ আচার্যও নেই!
ছোট্ট একটি হলঘর। ‘সাউন্ড সিস্টেম’ এমনই যে, সকলের বক্তব্য সুস্পষ্ট ভাবে শোনার উপায় নেই। রয়েছেন কয়েক জন শিক্ষক আর শিক্ষাকর্মী। সেখানেই সাম্মানিক ডিএসসি দেওয়া হল ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত, ৭৯টি সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী সিএনআর রাওকে। সাম্মানিক ডিলিট পেলেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
মঙ্গলবার এ ভাবেই সম্পন্ন হল প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ সমাবর্তন। যাঁদের জন্য এবং যাঁদের নিয়ে সমাবর্তন হওয়ার কথা, সেই পড়ুয়ারা তো ছিলেনই না। ছিল না ‘রোব’ বা বিশেষ পোশাকও, যেটা যে-কোনও সমাবর্তনের অপরিহার্য অঙ্গ। যাবতীয় আড়ম্বর এড়িয়ে এ দিন যে-ভাবে ওই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমাবর্তন হল, রাজ্যে কখনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা হয়েছে কি না— মনে করতে পারছে না শিক্ষা শিবির। আচার্য-রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী যাঁকে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার দায়িত্ব সঁপেছিলেন, সেই উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া বক্তব্যের শুরুতেই সকলের উদ্দেশে বলেন, ‘‘খুব দুঃখের সঙ্গে বলছি যে, এ ভাবে সমাবর্তন করতে হচ্ছে। দয়া করে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আমাদের সঙ্গে সকলেই ধৈর্য ধরে রাখবেন।’’
যদিও পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে উপাচার্য নিজেই ধৈর্য হারান বলে অভিযোগ। ছাত্রছাত্রীদের দাবি, সমাবর্তন নিয়ে কথা বলার সময় পড়ুয়াদের উপরে রেগে যান উপাচার্য। তাঁকে শান্ত করেন অন্য শিক্ষকেরা। পরে উপাচার্য জানান, সমাবর্তনে ডিগ্রি দেওয়া হয়নি ঠিকই। তবে বিভাগীয় প্রধানের কাছ থেকে পড়ুয়ারা তা সংগ্রহ করতে পারবেন।
উপাচার্যের ক্রোধের কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের যুক্তি, ছাত্র আন্দোলনের জেরেই ক্যাম্পাস থেকে নন্দনে সমাবর্তন সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হন কর্তৃপক্ষ। আন্দোলনকারীরা সোমবার ক্যাম্পাসের ফটকে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ দেখান। তাই ঢুকতে পারেননি উপাচার্য এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারা। পরে, রাতে সিদ্ধান্ত হয়, নন্দন-৩ নম্বর হলে সমাবর্তন হবে। সাত শতাধিক পড়ুয়ার ডিগ্রি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এক জনকেও এ দিন তা দেওয়া হয়নি। ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ, তাঁরা ডিগ্রি পেলেন না কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবেই।
ঐতিহ্য মেনে গত বার ক্যাম্পাসেই হয়েছিল সমাবর্তন অনুষ্ঠান।
গোটা ঘটনায় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধেই মুখ খুলেছেন সমাবর্তনে উপস্থিত বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ। তিনি বলেন, ‘‘আমার তো সন্দেহ হয়, এর পিছনে অন্য কোনও ফোর্স রয়েছে। আমি একদম নিশ্চিত। তালা দিয়ে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলে? পড়াশোনা না-হলে, চাকরি না-পেলে কী করবে? দাদাগিরি করবে? পড়ুয়ারা ভাবে, আন্দোলন না-করলে বুঝি জাতে ওঠা যায় না! রাজনীতি আমরাও করেছি। কিন্তু তার মধ্যে নৈতিকতা ছিল। জনগণের সম্পত্তিতে তালা লাগিয়ে দেবে?’’
প্রেসিডেন্সির নিজের ঘরে এই সমাবর্তন হতে না-পারাটা যে তার ঐতিহাসিক গৌরবের সঙ্গে মেলে না, সেটা বোঝাতে চেয়েছেন সাম্মানিক ডিএসসি প্রাপক সিএনআর রাও। তিনি বলেন, ‘‘প্রেসিডেন্সির ইতিহাসের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। দুর্ভাগ্যবশত বাংলার মানুষের মধ্যে নিজেদের ইতিহাস ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।’’ তাঁর মতে, প্রেসিডেন্সি দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পড়ুয়ারাও তার অংশ। ফলে বিক্ষোভ না-করে বোঝাপড়ার জায়গায় আসা উচিত। ‘‘আমরা সকলেই বড় কিছু পাওয়ার জন্য ছোট জিনিসকে ত্যাগ করি। এটা সকলের মাথায় রাখা উচিত,’’ বলেন রাও। আর সাম্মানিক ডিলিট প্রাপক সৌমিত্রবাবু বলেন, ‘‘এটা কর্তৃপক্ষ আর পড়ুয়াদের ব্যাপার। তাঁদেরই মিটিয়ে ফেলা উচিত।’’
আচার্য না-থাকায় অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন উপাচার্য। ‘অপুর সংসার’ ছবির প্রসঙ্গ টেনে সৌমিত্রবাবুর অভিনয়ের প্রশংসা করেন তিনি। তার পরে সোজা ঢুকে পজড়েন হিন্দু হস্টেলের প্রসঙ্গে।
উপাচার্য জানান, হিন্দু হস্টেল ১৩০ বছরের পুরনো। উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তাঁর কাছে হস্টেল মেরামতির দাবি তুলছিলেন ছাত্রেরা। হস্টেল সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সেটা করতে সময় লাগছে। কারণ কোনও জাদুদণ্ড নেই যে, ঘোরালেই হয়ে যাবে! এখন সংস্কারের কাজ করছে পূর্ত দফতর। বিরক্তির সুরে অনুরাধাদেবী বলেন, ‘‘পড়ুয়ারা হিন্দু হস্টেলে থাকতে আসেনি। প্রেসিডেন্সিতে পড়তে এসেছে। হস্টেল হল একটা সুবিধা, যেটা তারা অধিকারের দ্বারা অর্জন করেনি। এটা দেওয়া হয়। এটা আবশ্যিকও নয়। তা সত্ত্বেও তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু ওই বিশেষ ভবনটিই চাই। এবং এখনই চাই— এটা কি যুক্তিসঙ্গত? কেন পড়ুয়ারা এত মরিয়া?’’ হুঁশিয়ারির ঢঙে উপাচার্য বলেন, ‘‘কেউ ওদের ‘মিসগাইড’ করবেন না। তা হলে কিন্তু জীবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।’’
ছাত্রনেতা সায়ন চক্রবর্তীর প্রশ্ন, সোমবার বেলা সাড়ে ৩টের পরেই জানানো হয়েছিল, তাঁরা সমাবর্তনের বিরুদ্ধে নন। তা হলে ক্যাম্পাসের ডিরোজিও হলে সমাবর্তন হল না কেন? প্রায় ছ’ঘণ্টা পরে, রাত ৯টায় কেন সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, নন্দনে সমাবর্তন হবে? ‘‘আমরা চেয়েছিলাম, সমাবর্তন হোক ক্যাম্পাসেই। আসলে কর্তৃপক্ষ সমাবর্তনকারী আর আন্দোলনকারীদের মধ্যে ভেদাভেদের চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমরা সকলেই এক। ভেদাভেদ করে কোনও লাভ নেই,’’ বলেন সায়ন।
প্রেসিডেন্সির স্নাতক হয়ে শৌভিক দাস নস্কর, শতরূপা বসুরা বারাণসী, গ্বালিয়রে গিয়েছেন উচ্চশিক্ষার জন্য। সমাবর্তনে ডিগ্রির আশায় এসেছিলেন কলকাতায়। কিন্তু ডিগ্রি দূরের কথা, সমাবর্তনে যাওয়ার সুযোগই পাননি তাঁরা। প্রেসিডেন্সি লাগায়ো চায়ের দোকানে তাঁদেরই কয়েক জনকে আক্ষেপ করতে শোনা গেল, “তালাবন্ধ করার ঘটনাটা কয়েক দিন আগে বা পরে করলেই ভাল হত।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy