প্রতীকী ছবি।
পুরভোট, প্রশাসন, পরিষেবা― এ সবই একটা শহরের বাহ্যিক রূপকার। কিন্তু বহিরঙ্গের রূপটানে আমার নজর আটকায় না! তাই পাঁচ বছর বয়সি ভিন্ রাজ্যের সেই শিশুর মনে এ শহর থেকে গিয়েছে তার আন্তরিকতা, বিচক্ষণতা আর উদারতায়।
কলকাতায় জন্মের পরেই ফিরে যাই বারাণসীর কাছে আজ়মগড়ের গ্রামে। বাবা কলকাতায় শিক্ষকতা করতেন। তাই পাঁচ বছর বয়সে ফিরে আসি। ভবানীপুরের রমেশ মিত্র রোডের সেই ভাড়াবাড়ির ঠিকানা আজও মনে আছে। ছোট্ট ছেলের শিক্ষার পরিধি ওই পাড়া, স্কুলের পরিবেশ আর তার হেঁটেচলে বেড়ানোর জায়গাটিকেই সে বুঝত কলকাতা বলে। জেনেছিলাম, এ শহরে মতান্তর কখনও সখ্যে বাধা হয় না। তাই বাঙালি পরিসরে অবাঙালি শিশু ভিন্ন মত নিয়েও বন্ধু পেয়েছিল। অথচ বারাণসীতে তাকে প্রশ্ন করা হত, তুমি কি ক্ষত্রিয়, না ব্রাহ্মণ? সেই বুঝে হত বন্ধুত্ব। কলকাতাকে ভালবাসার মূল কারণ এই পার্থক্যই।
টাকা দিয়ে নয়, সে যুগে শিক্ষা আর মানসিকতা দিয়ে সম্মান মিলত। ধনকুবেরের ছেলের থেকে বেশি সমীহ পেতেন শিক্ষকের ছেলে। বুঝেছিলাম, কারও অধীন চাকরি করতে পারব না। তাই ষোলো বছর বয়সে যাদবপুরে গিয়েও মেডিক্যালে সুযোগ পেতেই পথ বদল করি। মনে হয়েছিল, ডাক্তারি পেশায় স্বাধীনতা আছে। মতের পার্থক্য সত্ত্বেও তা প্রকাশের স্বাধীনতা। এই বোধের জন্মদাতাও রমেশ মিত্র রোড।
জীবনের বহু ঘাত-প্রতিঘাতেও তাই সজীব সেই পাড়ার মামণিমা, ছোটদের গল্প বলা মুখগুলো, একটি দক্ষিণী পরিবার এবং মায়াদি। মামণিমার আসল নাম জানতেন না কেউই। সব বয়সিকে ডেকে কুশল জানতেন তিনি। কোনও স্বার্থ ছিল না তাঁর। বাচ্চাদের জাদু দেখাতেন, বিভিন্ন গল্প শোনাতেন কিছু মানুষ। রোজগারহীন মানুষগুলো এ সবের জন্য পয়সাও নিতেন না। অথচ তাঁদের আকর্ষণ আমাদের আনন্দ দিত। পাড়ার কাছে একটি দক্ষিণী পরিবারের বাস ছিল। পরীক্ষা আছে বললে তারা অপরিচিতদেরও প্রসাদ দিত। অভূতপূর্ব সেই স্বাদের টানে রোজ পরীক্ষা লেগেই থাকত। তবু সেই স্বাধীনতায় চিড় ধরেনি।
আর এক জন, আমার আর দাদার সেতার শিক্ষিকা মায়া মিত্র। আমরা দিদি বলতাম। বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসের পিছনে ছিল ওঁর বাগান ঘেরা দোতলা বাড়ি। বড় টিপ পরা দিদির নির্মল সেই হাসি আর কোথাও খুঁজে পেলাম না। অরবিন্দের ভক্ত দিদির ঘরের মিষ্টি ধূপের গন্ধ, বাগানের ফুলের গন্ধ মিশে স্বর্গীয় পরিবেশ হত। সুরে ভুল করার স্বাধীনতা ছিল। বকতেন না দিদি। এমন ভাবে ধরিয়ে দিতেন যে আর ভুল করতে ইচ্ছেই হত না। দিদির বাড়ি যাওয়ার দীর্ঘ পথে সব ক’টা বাড়ি থেকে হয় স্বরসাধনা, নয়তো বাদ্যযন্ত্রের শব্দ আসত। আমরা ওই রাস্তার নাম দিয়েছিলাম ‘মিউজ়িক্যাল লেন’।
আজও হাঁটি শহরের পথে। কিন্তু সুরগুলো হারিয়ে গিয়েছে। বহিরঙ্গে উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু অন্তর বদলে গেলে শহর চরিত্র হারিয়ে ফেলে, সেটা নিয়ে কেউ ভাবছি না। মানব মস্তিষ্কের তৃতীয় এবং উন্নত ভাগ, নিয়ো-কর্টেক্স যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মানুষ শুধুই উৎসবে নাচছেন, আনন্দে মেতে আছেন। চলছে গতে বাঁধা ভাবনায় হ্যাঁ মেলানোর প্রতিযোগিতা। নতুন ভাবনার কোটরে তালা পড়ে গিয়েছে। যার একটি উদাহরণ, পুর পরিষেবায় মা ও শিশুর চিকিৎসা পরিষেবা স্তিমিত। অথচ এ সবের জন্য বিরাট খরচের প্রয়োজন ছিল না। ছিল নিয়ো-কর্টেক্সের জাগরণ। একটু পিছনে হাঁটব।
নব্বইয়ের দশক। নিয়োনেটাল কেয়ার ইউনিট তখন কী? এ শহর জানত না। বিছানা, ২০০ ওয়াটের কয়েকটি বাল্ব, অক্সিজেন সিলিন্ডার, বাইরের বাতাস আটকাতে দরজামুখো বড় একটি পেডেস্টাল পাখা, অটোক্লেভের বদলে প্রেশার কুকার, হাইড্রোমিটার, জলীয় বাষ্প শুষে নিতে সিলিকা জেল এবং আট ঘণ্টার ডিউটিতে দু’জন করে জুনিয়রকে নিয়ে টিম গড়ে কম ওজনের যমজ সদ্যোজাতকে রক্ষা করেছিলাম। শহরের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল যাদের ফিরিয়ে দিয়েছিল। আজ তাঁরা ইঞ্জিনিয়ার এবং নার্সিং স্টাফ।
এগুলোর খরচ কি খুব বেশি? তবু এখনও কেন বরো স্তরে এমন সাধারণ পরিকাঠামোও তৈরি করা গেল না? কেন আজও প্রান্তিক মানুষদের ঠেলে দেওয়া হয় বড় হাসপাতালের জটে অথবা নার্সিংহোমের ফাঁসে। যে শিশু বা মায়ের ন্যূনতম বিশেষ যত্ন দরকার, তা বরো স্তরেই দেওয়া যেতে পারত। পুরসভার হাতেগোনা মাতৃসদনগুলিকে ফেলে রেখে উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অথবা অ্যানেক্স করা হচ্ছে। সেগুলি সচল রাখতে নিয়ো-কর্টেক্সের ব্যবহার অর্থাৎ, বিশেষ মস্তিষ্কের প্রয়োজন ছিল।
ওই যে, অন্য খাতের ভাবনা গুরুত্ব হারিয়েছে। সে কারণেই পুর প্রশাসনের কাছে গুরুত্ব হারাচ্ছে প্রান্তিক মা ও শিশুর লড়াই!
শিশুরোগ চিকিৎসক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy