Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

রিকশার পাদানিতে বসে কথামৃত পড়েন বিকাশ

সোদপুর রেল স্টেশনের কাছে সরকারি আবাসনের গেটে প্রতি দিন রিকশা নিয়ে দাঁড়ান রাজু। সওয়ারি থাকলে ভাল, না হলে রিকশার পাদানিতে বসে কথামৃত পড়েন। প্রথম খণ্ড শেষ করে এখন দ্বিতীয় খণ্ড ধরেছেন। তবে শুধু নিজে পড়েই থেমে থাকেন না রাজু।

কথামৃত হাতে বিকাশ চক্রবর্তী। শনিবার। নিজস্ব চিত্র

কথামৃত হাতে বিকাশ চক্রবর্তী। শনিবার। নিজস্ব চিত্র

শান্তনু ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৭ ০২:৩৩
Share: Save:

বস্তির ঘুপচি ঘরে তাঁর দিন কাটে। প্রতি দিন ভোর হতেই পঞ্চাশ টাকা ‘রোজ’-এ অন্যের রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। রাত পর্যন্ত তা নিয়েই দিব্যি কেটে যায়। সারা ক্ষণই মাথায় ঘোরে, কী ভাবে মানুষের উপকার করা যায়। আর মাঝে যেটুকু সময় অবসর মেলে, হাতে তুলে নেন শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত!

পরিচিতেরা মজা করে তাঁকে বলেন ‘খ্যাপা’। কিন্তু তাতে কিছুই যায় আসে না সোদপুরের সুখচর রাজাবস্তির বিকাশ চক্রবর্তী ওরফে রাজুর। হতদরিদ্র ওই রিকশাওয়ালা অবশ্য বলেন, ‘‘গরিব তো কী হয়েছে! মনটাই তো আসল রাজা।’’ আর সেই বিশ্বাসে ভর করেই আরও ছ’জন খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষকে নিয়ে রাজু তৈরি করে ফেলেছেন ‘চৈতন্য সঙ্ঘ’, নিজেদের থেকেও দুঃস্থদের সাহায্য করার জন্য। সেই সাহায্য কখনও কম্বল বা জামাকাপড় বিতরণ, তো কখনও পুজোপার্বণে জল-মিষ্টি দেওয়া। এর জন্য প্রত্যেক সদস্য বাড়িতে ছোট্ট একটা ঘটে প্রতি দিন দু’টাকা করে জমিয়ে রাখেন। ওই সাতটা ছোট ঘটই রাজুদের ভাল কাজের মূল তহবিল।

সোদপুর রেল স্টেশনের কাছে সরকারি আবাসনের গেটে প্রতি দিন রিকশা নিয়ে দাঁড়ান রাজু। সওয়ারি থাকলে ভাল, না হলে রিকশার পাদানিতে বসে কথামৃত পড়েন। প্রথম খণ্ড শেষ করে এখন দ্বিতীয় খণ্ড ধরেছেন। তবে শুধু নিজে পড়েই থেমে থাকেন না রাজু। রিকশায় বয়স্ক যাত্রীরা উঠলে তাঁদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে গোটা রাস্তা কথামৃত নিয়ে আলোচনা জুড়ে দেন। অনেক পরিচিত যাত্রী আবার নিজে থেকেই রাজুর মুখে কথামৃতের গল্প শুনতে চান।

কোন অংশটা পড়ছেন এখন? পড়ন্ত বিকেলে রিকশায় বসেই কথামৃতের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে রাজু বললেন, ‘‘রামকৃষ্ণদেব রাজেন্দ্র মিত্রের বাড়িতে গিয়েছেন রাম, মনমোহন, কেশব সেন-সহ আরও কয়েক জনকে নিয়ে।’’ কিন্তু হঠাৎ কথামৃত পড়ছেন কেন? বই থেকে মুখ তুলে বছর চল্লিশের যুবকের সহাস্য উত্তর, ‘‘ছোট থেকেই আমি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভক্ত যে!’’

আরও পড়ুন:একা ঘরে প্রৌঢ়াকে খুন

বই বন্ধ করে নীল রঙের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলেন রাজু। বললেন, ‘‘বাড়িতে বড় অভাব। তাই ক্লাস সেভেনের পরে আর পড়াশোনা হয়নি। আর অন্যের গোলামি করব না বলে কুড়ি বছর ধরে রিকশাই চালাচ্ছি।’’ ছোট থেকেই দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত। আর তখন থেকেই মনে সাধ হতো রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের বই প়ড়ার। কিন্তু কী বই পড়বেন, বুঝতে পারতেন না। রাজুর কথায়, ‘‘বেশি পড়াশোনা জানি না। তাই বইয়ের অত নামও জানি না। রিকশায় এক মাস্টারমশাই যাতায়াত করেন। তিনিই এক দিন কথামৃতের কথা বললেন।’’

কিন্তু পকেট তো বাড়ন্ত। তাই বইয়ের দোকান থেকে দরদাম করেও ফিরে এসেছিলেন। পরে পাঁচ মাস ধরে টাকা জমিয়ে কিনেছেন দুই খণ্ডের কথামৃত। আর এ ভাবেই টাকা জমিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নেশা তাড়া করে বেড়ায় দিদির বাড়িতে থাকা রাজুকে। তবে আজ তিনি একা নন। তাঁর সঙ্গে কাঁধ মিলিয়েছেন গমকলের কর্মী সনাতন সাঁতরা, হকার লিটন নাগ, চায়ের দোকানি স্বপন সেন, কেব্‌ল সংস্থার কর্মী টোকন দাস, গাড়িচালক বাবুয়া কর্মকার ও রোলের দোকানি টিঙ্কু দাস।

সকলে বললেন, ‘‘শুরুর সময়ে লোকে কত বাজে কথা বলেছিল। এখনও বলে। কিন্তু কিছুতেই কান দিইনি।’’ জানা গেল, প্রতি বছর পয়লা জানুয়ারি সোদপুরের ওই সরকারি আবাসনের গেটের কাছেই ত্রিপল টাঙিয়ে জৌলুসহীন এক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। সেখানেই প্রায় ১০০ জনকে শীতবস্ত্র দান করেন তাঁরা। রাজুর কথায়, ‘‘আমাদের থেকেও যাঁরা গরিব, তাঁদের দিই।’’ এ ছাড়া, প্রতি বছর পানিহাটি দণ্ডমহোৎসবের দিন আসা হাজারো মানুষকে তাঁরা লাড্ডু আর জল বিতরণ করেন। রাজু বললেন, ‘‘শুরুটা হয়েছিল দশ জনকে কাপড় দিয়ে আর জল-বাতাসা খাইয়ে।’’

২০০৯ থেকে শুরু রাজুদের পথ চলা। সেই সময়ে অনেকেই বাঁকা চোখে দেখতেন দরিদ্র মানুষগুলির এই প্রচেষ্টাকে। কিন্তু আজ তাঁরা একা নন। স্থানীয় ব্যবসায়ী থেকে অনেক স্থানীয় বাসিন্দাও তাঁদের পাশে এসেছেন। কেউ জল-মিষ্টি বিতরণের সময়ে দোকান বন্ধ রেখে জায়গা করে দেন, কেউ হিসেবের খাতা দেখে দেন, কেউ অনু‌ষ্ঠানের সময়ে প্রয়োজনীয় চিঠিপত্র লিখে দেন, কেউ আবার আর্থিক সাহায্যও করেন। যেমন, গোবিন্দ কুণ্ডু ও দেবব্রত সাহা। রাজুদের সঙ্গে তাঁরাও নেমে পড়েন জনসেবায়। তাঁদের কথায়, ‘‘কয়েক বছর দেখার পরে ভাবলাম এগিয়ে যাই, খারাপ কাজ তো করছেন না। ওঁরা একটা রথও বার করেন।’’

এ কথা শুনে রাজু শুধু বললেন, ‘‘কী ভাল আর কী মন্দ, অত জানি না। তিনি যা করান, তা-ই করি। যা বলান, তা-ই বলি!’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE