কোনও অজুহাতেই কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের আর পিছনে ফেলে রাখা যাবে না। দেশের সকল ক্ষেত্রে এ বার থেকে মেয়েরা কাজ করবেন এবং তাঁরা চাইলে রাতের শিফটেও কাজ করতে পারবেন। সোমবার সংসদের বাজেট অধিবেশনে এ কথা জানিয়েছেন দেশের মহিলা অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন।
কিন্তু এর পরেও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না শহরের সংগঠিত ক্ষেত্রের চাকুরিরতারা। রাতের শিফটে মহিলাদের কাজের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শর্তাবলী প্রতিটি কর্মস্থলে মেনে চলা হবে কি না, সেই প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা। কারণ, শহরের অধিকাংশ বেসরকারি সংস্থাতেই রাতের দিকে মহিলা কর্মীদের যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা নেই। ফলে রাতে বা ভোরে পুলকার বা বাসে-ট্রেনে যাতায়াত করতে গিয়ে ওই মহিলারা প্রায়ই হেনস্থার মুখে পড়েন বলে অভিযোগ।
তাঁদেরই এক জন, সল্টলেকের একটি কল সেন্টারের কর্মী দেবাঞ্জনা মুখোপাধ্যায় (নাম পরিবর্তিত) জানাচ্ছেন, প্রতিদিন রাত সাড়ে ১০টায় অফিস শেষে শেষ ডানকুনি লোকাল ধরেন তিনি। অত রাতে ফাঁকা মহিলা কামরার বদলে ট্রেনের জেনারেল কামরায় উঠে মাঝেমধ্যেই কটূক্তি শুনতে হয় তাঁকে। দেবাঞ্জনার কথায়, ‘‘ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। তাই নিরাপত্তার কথা না ভেবে তিন বছর ধরে এ ভাবেই চাকরি করছি।’’
এ দিনের বাজেটে অর্থমন্ত্রী সব ধরনের কাজে মহিলা কর্মী নিয়োগের কথা বললেও সংশয় থেকেই যাচ্ছে। কারণ শারীরিক শ্রম বিভাজন ও কার্যক্ষমতার কথা বিচার করে কল-কারখানায় মেশিন চালানো, চাষের কাজে লাঙল টানা, পাথর ভাঙা, উদ্ধারকার্যের মতো কাজে মহিলা কর্মীদের নিয়োগ করা হয় না। সেখানে কী ভাবে কোনও মহিলাকে নিয়োগ করা হবে, তার কোনও সরকারি নির্দেশিকা নেই। এ প্রসঙ্গে ‘পিপলস আর্কাইভ অব রুরাল ইন্ডিয়া’ (পারি)-র অনুবাদ সম্পাদক স্মিতা খাটোর বলেন, ‘‘এক দিকে শ্রমিক আইনে যে বদল আনা হচ্ছে, তাতে শ্রমিকদের কোনও সুরক্ষা-কবচ নেই। আট ঘণ্টার বদলে ১২ ঘণ্টা শ্রম দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অন্য দিকে বলা হচ্ছে, মেয়েদের সব জায়গায় কাজ করতে দিতে হবে। ক্ষমতায়নের নামে এ-ও এক ধরনের দ্বিচারিতা।’’ তাঁর প্রশ্ন, যেখানে মহিলা শ্রমিকেরা অপুষ্টিতে ভুগছেন বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সেখানে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাঁরা কী ভাবে শ্রমদান করবেন? কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে অর্থমন্ত্রীর এই ঘোষণা হলেও এখনও অসংগঠিত ক্ষেত্রে মহিলা কর্মীদের জন্য শৌচাগার, জল, স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো ন্যূনতম সুবিধার ব্যবস্থা কেন করা গেল না, সেই প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ।
শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক দেবযানী রায় মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, কর্মস্থলে গত ১২ বছরে রাতের শিফট করতে কখনও সমস্যায় পড়েননি তিনি। তবে নিরাপত্তাগত কারণে ইন্টার্ন থাকার সময়ে রাতের এনআরএসে মেয়েদের ইমার্জেন্সিতে কাজ না দেওয়ার ঘটনা তিনি দেখেছেন। দেবযানী বলেন, ‘‘২০০৬ সালের ঘটনা। আমি তখন ইন্টার্ন। রোগী পরিবার এক ডাক্তার দিদির গায়ে ব্লেড চালিয়ে দিয়েছিল। তার পর থেকে আমাদের ইমার্জেন্সিতে নাইট ডিউটি দেওয়া হত না।’’
এর আগেও পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং কাজের শর্তাবলী (কেন্দ্রীয়) বিধি, ২০২০-এর মাধ্যমে মেয়েদের রাতের শিফটে কাজ করার প্রস্তাব করেছিল কেন্দ্র। এ বার সম্ভবত তা ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হতে চলেছে। ওই প্রস্তাবে কর্মক্ষেত্রে রাতের শিফটে, রাত ৭টার পরে বা সকাল ৬টার আগে মেয়েদের কর্মস্থলে থাকার ক্ষেত্রে কিছু শর্তাবলীর কথা বলা হয়। তার মধ্যে অন্যতম রাতের শিফটে কাজের ক্ষেত্রে মহিলার কর্মীর সম্মতির বিষয়টি। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। অভিযোগ, মহিলা কর্মীরা রাজি না-হলেও তাঁদের দিয়ে রাতের শিফটে কাজ করাচ্ছে শহরের বহু প্রতিষ্ঠান।
সদ্য মা হওয়ার পরে শহরের এক কর্পোরেট সংস্থায় গ্রাফিক ডিজ়াইনার হিসেবে যোগ দিয়ে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন কসবার রূপা মজুমদার (নাম পরিবর্তিত)। তিনি বলছেন, ‘‘প্রথম প্রথম রাতের শিফট করতাম। করোনার সময়ে বাড়ি থেকে কাজ শুরু হল। নাইট শিফট কখনও দুপুর অবধি গড়িয়ে যেত! পরের দিকে আর পেরে উঠছিলাম না ছোট বাচ্চা নিয়ে। বাধ্য হয়ে চাকরি বদলাই।’’ এ সব ক্ষেত্রে মহিলা কর্মীদের রাতের শিফটে কাজ করতে দেওয়ার প্রস্তাব ব্যুমেরাং হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।
তবে উল্টো মতও আছে। রাতের শিফটের কারণে দিনে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর কথা বলছেন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত দেবারতি সরকার বিশ্বাস। তাঁর দাবি, রাতের শিফটে কর্মরত মহিলা কর্মীদের জন্য তাঁর সংস্থা যথেষ্ট যত্নবান। ‘‘মেয়েদের রাতের শিফট করা নিয়ে সমাজের মানসিকতা এখনও বদলায়নি। ফলে অনেকের বাড়িতেই রাতে কাজ করা নিয়ে আপত্তি থাকে। আমার বিয়ের সম্বন্ধ দেখার সময়ে রাতের শিফটের কারণে চাকরি ছাড়ার মতো কথাও শুনতে হয়েছিল। চাকরি নয়, পাত্রকেই ছেড়ে দিয়েছিলাম!’’— অকপটে বলছেন দেবারতি।
প্রসঙ্গত, এ দিন অর্থমন্ত্রী যখন কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের বিশেষ সুবিধার কথা বলছেন, তখনই কলকাতা-সহ বিভিন্ন জেলায় অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা শ্রমিকদের স্থায়ী চাকরি, সম কাজে সম বেতন, ন্যূনতম মজুরির মতো নানা দাবিতে অনশন-প্রতিবাদ চলছে। তাই প্রশ্ন উঠছে, অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি কার্যক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy