Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

কাঠামোর ক্লান্তি মাপতে চালু হোক ‘ব্রিজ রেটিং’

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগের শিক্ষক গোকুল মণ্ডল বলেন, ‘‘কোনও উড়ালপুল বা সেতু যে সামগ্রী দিয়ে তৈরি অর্থাৎ কংক্রিট, লোহা বা স্টিল— সেই উপাদানগুলির বর্তমান ভার বহন ক্ষমতা ‘ব্রিজ রেটিং’ সমীক্ষার মাধ্যমেই বোঝা যাবে। সেটা খুবই প্রয়োজন

অনিয়ম: নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করেই শহরের সেতুগুলি দিয়ে চলে ভারী মালবাহী গাড়ি। ফাইল চিত্র

অনিয়ম: নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করেই শহরের সেতুগুলি দিয়ে চলে ভারী মালবাহী গাড়ি। ফাইল চিত্র

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:৫০
Share: Save:

প্রতি ঘণ্টায় শহরের উড়ালপুল-সেতুগুলির উপর দিয়ে গাড়ি চলাচলের সংখ্যা, আদৌ সেগুলির সেই ভার বহনের ক্ষমতা রয়েছে কি না, তা পরীক্ষার জন্য অবিলম্বে ‘ব্রিজ রেটিং’ সমীক্ষা চালুর প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। ‘ব্রিজ রেটিং’ সমীক্ষার মাধ্যমেই পরিষ্কার হয়ে যাবে, শহরে উড়ালপুল ও সেতুগুলির বর্তমান ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বা তাতে কত পরিমাণ সংস্কার দরকার। কারণ, মাঝেরহাট সেতু ভাঙার অন্যতম কারণই হল, দীর্ঘ সময় ধরে ভার বহনের ফলে কাঠামোয় ক্লান্তি জমা। বিশেষজ্ঞদের মতে, তিন দশকের পুরনো সেতুর ক্ষেত্রে ‘ব্রিজ রেটিং’ সমীক্ষা চালু করাটা প্রায় বাধ্যতামূলক। যেখানে শহরের সবক’টি সেতুরই বয়স তিরিশ বছরের বেশি।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগের শিক্ষক গোকুল মণ্ডল বলেন, ‘‘কোনও উড়ালপুল বা সেতু যে সামগ্রী দিয়ে তৈরি অর্থাৎ কংক্রিট, লোহা বা স্টিল— সেই উপাদানগুলির বর্তমান ভার বহন ক্ষমতা ‘ব্রিজ রেটিং’ সমীক্ষার মাধ্যমেই বোঝা যাবে। সেটা খুবই প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে উড়ালপুল বা সেতুর বিভিন্ন অংশ থেকে উপাদানের সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা করে বোঝা সম্ভব তার বর্তমান ভার বহনের ক্ষমতা কতটা। কারণ, উড়ালপুল বা সেতুটির নকশা যখন তৈরি হয়েছিল, তখন যে পরিমাণ ক্ষমতা ছিল, বর্তমানে তা থাকতে পারে না। সেই সব বিষয়ই বেরিয়ে আসবে ব্রিজ রেটিংয়ের পরীক্ষায়।’’

পাশাপাশি বিপজ্জনক বাড়ির মতো মেরামতের অযোগ্য ‘বিপজ্জনক’ উড়ালপুল ও সেতুকে ‘কনডেমড’ ঘোষণার বিষয়টিও বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে প্রশাসনের অভ্যন্তরে। কারণ, রাইটস দেড় বছর আগে যে পাঁচটি সেতুর সংস্কারের প্রয়োজন বলে রিপোর্ট জমা দিয়েছিল, সেখানে সেগুলি অবিলম্বে সারাইয়ের কথা বলা হয়েছিল। রিপোর্টে হাওড়ার বঙ্কিম সেতু ও বাঘা যতীন সেতুর সংস্কারের উপরেও বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার কথাও ছিল ওই রিপোর্টে। বলা হয়েছিল, ‘পারলে এখনই সংস্কার শুরু করা হোক’! যদিও সে কাজ এখনও শুরু হয়নি বলেই রাজ্য সরকার সূত্রের খবর।

আরও পড়ুন: বেহালা থেকে চাঁদনি আসতে লাগল তিন ঘণ্টা

প্রশাসনের কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, এক দিকে উড়ালপুল এবং সেতুর বয়স বাড়ছে। অন্য দিকে, সেগুলি সংস্কার করা হচ্ছে না। বরং আগের থেকে অনেক বেশি সংখ্যক যান তার উপর দিয়ে চলাচল করছে। ফলে সেগুলির কাঠামো ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। শিবপুর আইআইইএসটি-র ‘আরবান ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ বিভাগের শিক্ষক দীপঙ্কর সিংহও বলেন, ‘‘এর আগে একাধিক সেতু ভেঙে তা নতুন ভাবে তৈরি করা হয়েছিল। কারণ, সেগুলি মেরামতের অযোগ্য ছিল। বর্তমানে অনেক সেতুর অবস্থা সে দিকে যাচ্ছে কি না, সেটাও দেখা প্রয়োজন। তেমনটা হলে সেগুলি কনডেমড ঘোষণা করা যেতেই পারে।’’

কিন্তু যদি সত্যিই এমন অবস্থা তৈরি হয় যে, কোনও উড়ালপুল বা সেতু পরিত্যক্ত ঘোষণা করে তা ভেঙে ফেলতে হল, তা হলে নতুন উড়ালপুল ও সেতুর নকশার ক্ষেত্রে ‘কনজেশন ফ্যাক্টর’ বলে গত বছরই একটি নতুন বিষয় যোগ করতে বলেছে ‘ইন্ডিয়ান রোডস কংগ্রেস’ (দেশের সড়ক বিশেষজ্ঞ ও ইঞ্জিনিয়ারদের অ্যাপেক্স বডি)। প্রসঙ্গত, কোনও উড়ালপুল ও সেতুর উপর দিয়ে দৈনিক গড়ে ক’টি গাড়ি চলাচল করছে, তার হিসেবের উপরে ভিত্তি করে একটা নকশা তৈরি করা হয়। নতুন নিয়মে, সংশ্লিষ্ট সেতু ও উড়ালপুলের গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত যদি কোনও কারণে মালবাহী ট্রেলার পরপর দাঁড়িয়ে যায়, তা হলেই বোঝা যাবে ওই ‘কাল্পনিক’ অবস্থায় সেতু বা উড়ালপুলটি সর্বোচ্চ কত ভার নিতে পারবে। প্রস্তাবিত নকশায় সেই ‘কনজেশন ফ্যাক্টর’টি যোগ করার কথা বলা হয়েছে। এক উড়ালপুল বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘শহর ও শহরতলিতে গাড়ির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ফলে কোনও উড়ালপুল বা সেতুর উপরেও সেই চাপ আসছে। সেই কারণে নকশায় কনজেশন ফ্যাক্টর যোগ হলে অনেক বেশি কংক্রিট, লোহা বা স্টিল ব্যবহার করা হবে। ফলে অনেক মজবুত হবে।’’

কিন্তু শহরের প্রায় সব ক’টি উড়ালপুল ও সেতুই যেহেতু অনেক বছরের পুরনো, তাই সে ক্ষেত্রে এই নতুন বিষয় যোগ করার কোনও সুযোগই নেই। পুরনোগুলির ক্ষেত্রে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে উড়ালপুল বা সেতুর সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়ানো যায় বলে মনে করছে প্রশাসনের একাংশ। কিন্তু নিরাপত্তার দিকটি উপেক্ষা করে অত্যধিক মালবাহী লরি, ট্রেলারের পুরনো সেতুগুলির উপর দিয়ে অবাধে যাতায়াতের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন প্রশাসনের অনেক পদস্থ কর্তাই। এক কর্তার কথায়, ‘‘শহরের অনেক জায়গাতেই সেতুর উপর দিয়ে অত্যধিক ভারযুক্ত লরি, ট্রেলার যাতায়াত করে। কিন্তু সেগুলো স্বাভাবিক ভাবেই আটকানো যায় না। কারণ, তাতে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হবে। তবে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু ভাবা দরকার। না হলে সেতুর ক্ষতি আটকানো যাবে না।’’

(শহরের প্রতি মুহূর্তের সেরা বাংলা খবর জানতে পড়ুন আমাদের কলকাতা বিভাগ।)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE