Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

প্রিয়জনের কাছে মৃতের ফিরে আসা অস্বাভাবিক নয়

মাস ছয়েক ধরে দিদির মৃতদেহ আগলে রেখেছেন তিনি। খেতে দিয়েছেন। এমনকী বাড়ির মধ্যেও নানা ভৌতিক শব্দের ব্যবস্থা করে আত্মার ফিরে আসার পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। এমনটাই দাবি ভাইয়ের। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে দেখলে এটা হয়তো একাকীত্ব বা বড়সড় কোনও ধাক্কা খেয়ে বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার ফল। কিন্তু সাইকিক দিক থেকে পুরোটাকে বোধ হয় মানসিক সমস্যা বা পাগলামি বলে উড়িয়ে দেওয়াটা উচিত হবে না।

ঈপ্সিতা রায় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৫ ০০:৩৫
Share: Save:

মাস ছয়েক ধরে দিদির মৃতদেহ আগলে রেখেছেন তিনি। খেতে দিয়েছেন। এমনকী বাড়ির মধ্যেও নানা ভৌতিক শব্দের ব্যবস্থা করে আত্মার ফিরে আসার পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। এমনটাই দাবি ভাইয়ের। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে দেখলে এটা হয়তো একাকীত্ব বা বড়সড় কোনও ধাক্কা খেয়ে বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার ফল। কিন্তু সাইকিক দিক থেকে পুরোটাকে বোধ হয় মানসিক সমস্যা বা পাগলামি বলে উড়িয়ে দেওয়াটা উচিত হবে না।

আমার বিশ্বাস, পার্থবাবু দিদিকে দেখতে পেতেন। দেবযানীর আত্মাও ওই বাড়িতে ফিরে আসত। পার্থবাবুর কিছু ব্যবহারই সে দিকে ইঙ্গিত করছে।

প্রথমত, দিদিকে নিয়মিত খেতে দিতেন ভাই। হিন্দু ধর্ম-সহ বিভিন্ন ধর্মে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। মৃত্যুর পরে আত্মা ফিরে আসে, এই বিশ্বাসেই খাবার, পোশাক, ব্যবহার্য সামগ্রী দেওয়া হয়। হিন্দুধর্মে শ্রাদ্ধও তো তাই। খাবার, পোশাক দিয়ে, প্রার্থনা করে আত্মাকে জাগিয়ে তোলার রীতি রয়েছে চিনদেশে। দেশ-বিদেশের নানা জায়গাতেই এ ধরনের রীতি-রেওয়াজ আছে। উল্লেখ রয়েছে ইতিহাসেও। মিশরের পিরামিডে মমির সঙ্গে খাবার তো বটেই, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রই রাখা হতো। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে খাবার উৎসর্গের রীতি ছিল উত্তর আমেরিকাতেও। দিদির অস্তিত্ব টের না পেলে শুধু ভালবেসেই কি দিদিকে খাবার দিতেন পার্থবাবু? যে খাবার তিনি দেবযানীকে দিতেন, তার কিছুটা নিশ্চয়ই সত্যিই কাউকে খেতে দেখতেন। সে খাবারগুলো যেত কোথায়? দ্বিতীয়ত, বাড়িতে আত্মার ফিরে আসার মতো পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। দিদিকে দেখতে না পেলে, তিনি ফিরে আসেন টের না পেলে, শুধু বিশ্বাসে হয়তো পার্থবাবু এমন করতে পারতেন না। আত্মার ফিরে আসার জন্যও এ ধরনের পরিবেশ উপযোগী।

মৃত্যুর পরে আত্মা পৃথিবীর সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলতে পারেন না। বিভিন্ন সময়ে তার প্রমাণ মিলেছে। যথেষ্ট গবেষণাও হয়েছে অতীতে, এখনও হচ্ছে। পরিবারের মধ্যে খুব বেশি ভালবাসা থাকলে, সম্পর্ক মজবুত হলে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনেও সেই টান কাটিয়ে ওঠা যায় না। সেই জন্যই মৃতেরা পৃথিবীতে ফিরে আসেন, চেনা মানুষের আশপাশে, চেনা জায়গায় ঘুরে বেড়ান, কাছের লোক হয়তো তাঁদের দেখতেও পান। আমার পেশার সূত্রে এ রকমটা দেখেছি অনেক বার। আমার বিশ্বাস, এই পরিবারেও ভালবাসার বন্ধনটা ছিল খুব মজবুত। তাই ভাই দিদিকে ছেড়ে থাকতে পারেননি। দেবযানীও বাড়ি ছেড়ে, পরিবারকে ছেড়ে চিরতরে চলে যেতে পারেননি।

একই জিনিস হয়েছে পোষা কুকুর দু’টির ক্ষেত্রেও। পোষ্যদের সঙ্গে কতটা বন্ধন তৈরি হয়ে যায়, তা যে কোনও পশুপ্রেমী বা যাঁরা বাড়িতে কোনও পশুপাখি পুষেছেন, তাঁরা জানেন। বিদেশের এক গবেষণা বলছে পশুপাখি, বিশেষত পোষ্যরাও ভালবাসার টানে বাঁধা পড়ে। তাদেরও আত্মার অস্তিত্ব আছে, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন আছে। ভালবাসা পেলে, সেই মায়া কাটাতে না পেরে তাদের আত্মাও ফিরে আসে। গল্পে-সিনেমায় তো বটেই, বাস্তবেও তো এমন প্রমাণ মিলেছে বহু বার। পোষা কুকুরকে কেউ হয়তো খুব ভালবাসতেন। কুকুরের মৃত্যুর পরে কোনও বিপদ থেকে অলৌকিক ভাবে বেঁচে গিয়েছেন তাঁর মালিক কিংবা কুকুরটিই এসে বাঁচিয়ে দিয়ে গিয়েছে, এমন ঘটেছে অনেকের সঙ্গেই। আমার নিজের পোষা কুকুর জ্যাকি মারা যাওয়ার পরে এক দিনের এক অভিজ্ঞতায় আমারও মনে হয়েছিল জ্যাকি এসেছিল আমার ঘরে।

আমরা কেউ বিশ্বাস করি, কেউ করি না। কেউ বুঝতে পারি, কেউ পারি না। কিন্তু মৃত্যুর পরেও ভালবাসা বেঁচে থাকে। মৃত্যুর পরের জীবনে থেকে যায় সেই ভালবাসার টান।

সবশেষে একটা কথা বলার। শুনলাম পার্থবাবু নাকি ডায়েরিতে লিখেছিলেন, তাঁর মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী এক ডাইনি, যিনি নাকি আসলে তাঁর ঠাকুরমা। হয়তো তাঁর মায়ের সঙ্গে ঠাকুরমার বনত না। সে কারণেই ঠাকুরমার উপরে তাঁর ঘৃণা বা বিতৃষ্ণা তৈরি হয়। তারই ফলে ঠাকুরমা সম্পর্কে এমন কথা বলেছেন তিনি। অপছন্দের কোনও নারী সম্পর্কে এই বিশেষণটা ব্যবহার করার এই অভ্যাসটা অনেক পুরনো, আর এখনও বেশ প্রচলিত। আসলে কোনও নারী তাঁদের থেকে বেশি ক্ষমতার অধিকারী, তাঁকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না, এই ভাবনা থেকেই সেই নারীকে ‘ডাইনি’ আখ্যা দিত অতীতের পুরুষ মানুষ। রটিয়ে দিত ওই নারী সকলের ক্ষতি করে। ফলে তাঁর ক্ষমতা খর্ব করে ফেলা সহজ হতো। যুগ বদলেছে, সমাজ পাল্টেছে। তবু সেই ধারণাটা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যায়নি। গ্রামেগঞ্জে ডাইনি অভিযোগে মেরে ফেলার ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটে। খাস কলকাতাতেও হল।

(লেখক ডাইনি-বিদ্যা বিশারদ)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE