পাঠ: বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে...। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, প্রয়াত রমেশচন্দ্র মজুমদার ১৯৬২-র বিধানসভা নির্বাচনে ‘সংযুক্ত বিপ্লবী পরিষদ’-এর প্রার্থী হয়ে বেহালা কেন্দ্র থেকে দাঁড়িয়েছিলেন। ওই দলের কাছে ‘আমরা বাঙালি’, এই মতাদর্শ অন্যতম ছিল। ফলাফল বলছে, সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের তিন জন প্রার্থীর মধ্যে সব থেকে কম ভোট পেয়েছিলেন রমেশচন্দ্র। ওই কেন্দ্রের ৬৪,৮৫২টি বৈধ ভোটের মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন মাত্র ৫,৯৯০টি।
স্মৃতি রোমন্থন করে শিক্ষাবিদ সৌরীন ভট্টাচার্য জানালেন, প্রয়াত ইতিহাসবিদের মতো পণ্ডিত, বিদ্বান ব্যক্তি খুবই কম ছিলেন। কিন্তু তাঁর ‘আমরা বাঙালি’ মনোভাব, নির্বাচনে দাঁড়ানো এবং পরাজিত হওয়া নিয়ে অনেক নেতিবাচক চর্চাও হয়েছিল। ১৯৬২ সালের পরেও একাধিক বার বাংলা ভাষা নিয়ে বিপ্লব হয়েছে বা হচ্ছে। সেখানে বাংলায় হোর্ডিং লেখা, চিকিৎসকদের বাংলায় প্রেসক্রিপশন লেখা-সহ সবই রয়েছে। কিন্তু এই ভাষার ভবিষ্যৎ এ সবের উপরে নির্ভর করছে না বলেই বিশ্বাস সৌরীনবাবুর। তাঁর কথায়, ‘‘সারা বিশ্বের প্রায় ২৯-৩০ কোটি মানুষের কথ্য ভাষা বাংলা। ফলে বাংলা নিয়ে গেল-গেল রব তোলার পক্ষপাতী নই।’’
২০১১ সালের জনগণনা রিপোর্টও বলছে, শুধুমাত্র সংখ্যার নিরিখে দেশে হিন্দির পরেই সব থেকে বেশি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। সারা দেশে এই মাতৃভাষার মানুষ ৯ কোটি ৭২ লক্ষ ৩৭ হাজার ৬৬৯ জন এবং পশ্চিমবঙ্গে ৭ কোটি ৮৬ লক্ষ ৯৮ হাজার ৮৫২ জন। জনগণনায় মাতৃভাষার সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে, মা সন্তানের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেন, সেটিই মাতৃভাষা। কারও মা শৈশবেই মারা গেলে পরিবারের ভাষাই মাতৃভাষা। শিশু ও মূক-বধিরদের ক্ষেত্রে মায়ের ভাষাই মাতৃভাষা। সংশয় থাকলে সংশ্লিষ্ট পরিবারের কথ্য ভাষাকেই মাতৃভাষা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয় বলে জনগণনায় বলা হয়েছে।
তবে বাংলা ভাষাকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার বর্তমান অবস্থা ঠিক করা যেমন উচিত নয়, তেমনই জনগণনায় উল্লিখিত মাতৃভাষার সংজ্ঞা দিয়ে বাংলা ভাষা সুরক্ষিত, এই ধারণাও ঠিক নয় বলেই জানাচ্ছেন বিদ্বজ্জনেরা। কারণ, মাতৃভাষা বাংলা হিসেবে জনগণনায় নথিভুক্ত হলেও শিশুটি যখন বড় হচ্ছে, তখন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেই বাংলার কতটা প্রয়োগ হচ্ছে বা আদৌ হচ্ছে কি না, জীবন জুড়ে থাকছে কি না, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে জানাচ্ছেন তাঁরা।
ভাষাবিদ পবিত্র সরকার বলছেন, ‘‘অনেক বাংলা মাধ্যম স্কুলকে ইংরেজি মাধ্যমে করার সরকারি সিদ্ধান্ত বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে সর্বনাশা। কারণ, এর মাধ্যমে বাংলা কোনও কাজের ভাষা নয়, এই বার্তাই যাচ্ছে। যেন ইংরেজি ভাষা চর্চাতেই সব সাফল্য, অর্থ, প্রতিপত্তি মেলে।’’ এ ক্ষেত্রে ‘মৃত ভাষা’র প্রসঙ্গও টেনে আনছেন শিক্ষাবিদেরা। কোনও ভাষার ভবিষ্যৎ তা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বাহিত হচ্ছে কি না, তার উপরে নির্ভর করে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। না হলে সেই ভাষার যাঁরা ধারক-বাহক অর্থাৎ মধ্যবয়সি প্রজন্মের মৃত্যু হলে সংশ্লিষ্ট ভাষাটিও হারিয়ে যায়। এ বিষয়ে সৌরীনবাবুর বক্তব্য, ‘‘বাংলা নিয়ে গেল-গেল রবে বিশ্বাসী নই। তবে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষা কতটা ছড়িয়ে পড়ছে, সেটা নিয়ে উদ্বেগের কারণ রয়েছে। সেখানে বাংলা শেখানোর পদ্ধতিকে সময়োপযোগী করাটা ভীষণই প্রয়োজন।"
২০১১ সালের জনগণনায় এ রাজ্যে ০-৬ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৫ লক্ষ ৮১ হাজার ৪৬৬। ন’বছর পরে অর্থাৎ বর্তমানে ওই শিশুদের বয়স ৯-১৫ বছরের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। তাদের মধ্যে যারা পড়াশোনা করছে, সেই গোষ্ঠীর কত জন কোন মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হয়েছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বলে জানাচ্ছেন শিক্ষাবিদেরা। তাঁদের মতে, মাতৃভাষা বাংলা হলেও তা থেকে বিযুক্ত হওয়া এই বয়স বা তার আশপাশের মধ্যেই ঘটে থাকে। কারণ, অভিভাবকদের সিংহভাগ সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করান। তখনই ‘গুরুত্বহীন’ হয়ে যায় বাংলা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান তথা নাট্যব্যক্তিত্ব আনন্দ লালের কথায়, ‘‘ইংরেজি শেখার সঙ্গে বাংলার কোনও বিরোধ নেই। একাধিক গবেষণায় ইতিমধ্যেই প্রমাণিত, শিশুরা সহজেই ন্যূনতম তিনটি ভাষা শিখতে পারে। সেখানে অভিভাবকেরাই বাংলাকে গুরুত্বহীন করলে শিশু তো সে ভাবেই বেড়ে উঠবে।’’ বাংলাকে গুরুত্ব না দেওয়ার পিছনে আসলে মানসিক হীনম্মন্যতা কাজ করে বলে জানাচ্ছেন মনোবিদ নীলাঞ্জনা স্যান্যাল। তাঁর কথায়, ‘‘মধ্যবিত্ত পরিবারে ইংরেজিতে কথা বলার চল প্রায় নেই-ই, ফলে তাদের বেশি পিছিয়ে পড়ার ভয়। এই ভয় থেকেই ইংরেজিকে গুরুত্ব দেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়।’’
তবে শিক্ষাবিদেরা এই কথাটিও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ঝাড়খণ্ড, শিলচর, আন্দামান বা বিদেশের বাংলাভাষীদের মধ্যে বাংলার অবস্থান কোথায়, তা না-দেখে শুধুমাত্র কলকাতায় কত জন ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে, তার উপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ বিচার করা ঠিক নয়। যেমন ভাবে ঠিক হবে না ‘এটাই শুদ্ধ বাংলা ভাষা’, এমন কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া। আনন্দ লালের কথায়, ‘‘যে কোনও ভাষাই বিবর্তনের ক্ষেত্রে স্বনির্ভর। এক সময়ের সাধু থেকে চলিত ভাষা হয়ে বর্তমানের বাংলায় অজস্র হিন্দি, ইংরেজি শব্দ এসে মিশছে। এই অনুপ্রবেশ আটকানো যাবে না। কিন্তু বাংলা ভাষার ভিত এতটাও দুর্বল নয় যে সেই অনুপ্রবেশে তা বিপন্ন হয়ে যাবে। বরং হিন্দি-ইংরেজি শব্দের সঙ্গে সহাবস্থান করেই বাংলা ভাষা দাঁড়িয়ে থাকবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy