সাত মাসের ব্যবধান। ফিরে এল আরজি কর আন্দোলনের সময়কার সরকারি প্রতিষ্ঠান ঘিরে অবস্থানের ছবি। স্থান সেই সল্টলেক। যদিও একটি অবস্থান ছিল সেক্টর ফাইভে। অন্যটি ঘটছে সেক্টর থ্রি-তে। স্থান এক হলেও পাত্র আলাদা। কারণও ভিন্ন। সল্টলেকে করুণাময়ী আবাসনের অদূরে আচার্য সদনের (এসএসসি দফতর) সামনে যে ঘেরাও-অবস্থান সোমবার দুপুর থেকে শুরু হয়েছে, তার নানা ধাঁচ মিলে যাচ্ছে আরজি কর হাসপাতালের ঘটনার পরে সল্টলেকেরই স্বাস্থ্য ভবন ঘেরাওয়ের আন্দোলনের সঙ্গে।
বস্তুত, বিরোধী শিবির চাইছে, ঝিমিয়ে-পড়া আরজি কর আন্দোলন চাকরিহারাদের এই আন্দোলন থেকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন টেনে নিক। আরজি করের সময় যে নাগরিক আন্দোলন হয়েছিল, চাকরিহারাদের আন্দোলন ঘিরেও সেই একই আবহ তৈরি হোক। শাসকদলও মানছে যে, স্বাস্থ্য ভবনের অবস্থানের মতোই পরিস্থিতি ‘তৈরি’ করার চেষ্টা চলছে আচার্য সদন ঘিরে।
স্বাস্থ্য ভবনের অবস্থান চলেছিল দিনের পর দিন। আচার্য ভবনের সামনে অবস্থান সোমবার থেকে শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য ভবনের সামনের অবস্থানে সাধারণ মানুষ খাবার এবং পানীয় জল নিয়ে পৌঁছেছিলেন আন্দোলনকারীদের জন্য। আচার্য ভবনের সামনে অবস্থানকারীদের জন্যও লোকজন খাবার এবং জল নিয়ে যাওয়ার আবেদন জানাতে শুরু করেছেন সমাজমাধ্যমে। বস্তুত, চাকরিহারা শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীদের এই আন্দোলনকে আরজি কর আন্দোলনের মতো করেই গড়ে তোলার একটা ‘সচেতন’ প্রয়াসই রয়েছে। সোমবার রাতেই যেমন আরজি করের ঘটনার পরে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা গিয়েছিলেন চাকরিহারাদের অবস্থানে। তাঁরা নিয়ে গিয়েছিলেন খাবার এবং পানীয় জল। বেশি রাতে সেই অবস্থানে পৌঁছোন কলকাতা পুরসভার বিজেপি কাউন্সিলর সজল ঘোষ। আশপাশের বেশ কিছু বাড়ির বাসিন্দারা আন্দোলনকারীদের জানিয়েছেন, প্রয়োজনে তাঁরা এলাকার বাসিন্দাদের বাড়ির শৌচাগার ব্যবহার করতে পারেন। একই পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল আরজি কর আন্দোলনের সময়েও।
আরও পড়ুন:
যে কয়েক হাজার চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী সোমবার দুপুর থেকে বসে রয়েছেন আচার্য সদন ঘিরে, তাঁদের মধ্যে মহিলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। কেউ হাওড়া থেকে এসেছেন। কোলের শিশুসন্তানকে সঙ্গে নিয়েই অবস্থানে বসেছেন। কেউ অবস্থানে বসেছেন অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়। ভ্যাপসা গরম, পানীয় জল এবং শৌচাগারের অভাব মেনে নিয়েও তাঁরা ঠায় বসে রয়েছেন যোগ্য-অযোগ্যের তালিকা প্রকাশের দাবিতে।
গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর থেকে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের স্বাস্থ্য ভবনের সামনে অবস্থান শুরু করেছিলেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। আরজি করের ঘটনার পর সারা কলকাতা তো বটেই, রাজ্যের বহু এলাকায় ‘নাগরিক আন্দোলন’ তৈরি হয়েছিল। সেই সহ-নাগরিকেরা স্বাস্থ্য ভবনের সামনে অবস্থানকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের জন্য বিপুল পরিমাণে পানীয় জল এবং খাবার নিয়ে আসতে শুরু করেছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সল্টলেক ক্যাম্পাসে গণ-হেঁশেল তৈরি হয়েছিল।
করুণাময়ী চত্বরেও সোমবার রাত থেকে খানিক ছোট আকারে হলেও কার্যত সেই আবহ দেখা যাচ্ছে। রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ কাউন্সিলর সজল পিকআপ ভ্যানে জলের বোতল নিয়ে পৌঁছেছিলেন অবস্থানকারীদের কাছে। এক ভ্যান জলের বোতল নিমেষে ফুরিয়ে যায়। রাত সাড়ে তিনটে পর্যন্ত দফায় দফায় সেখানে জল পৌঁছে দিয়েছেন সজল। আরজি কর আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা জুনিয়র ডাক্তাররাও পানীয় জল এবং খাবার নিয়ে রাতে পৌঁছোন। সজল জানিয়েছিলেন, মহিলা বিক্ষোভকারীদের জন্য তিনি অবস্থানস্থলে অবিলম্বে বায়ো-টয়লেট বসানোর ব্যবস্থা করছেন। পরে তিনি অভিযোগ করেন, ‘পুলিশি বাধায়’ মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত বায়ো-টয়লেট পৌঁছে দিতে পারেননি। তাই সকালে করুণাময়ীর আশপাশের বাড়িগুলির বাসিন্দাদের অনেকে নিজেদের বাড়ির দরজা খুলে দেন। তাঁদের বাড়ির শৌচাগার ব্যবহার করেন আন্দোলনকারীরা। পরে সজলের পাঠানো বায়ো-টয়লেট পৌঁছে যায়।
আরও পড়ুন:
আচার্য সদনের প্রবেশপথ এবং গোটা অবস্থানস্থল সোমবার থেকেই ঘিরে রেখেছে পুলিশ। অবস্থানকারীদের তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। উভয়পক্ষে তর্কাতর্কি হয়েছে। কয়েক বার ঈষৎ ধস্তাধস্তিও হয়েছে। কিন্তু জমায়েত সরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরোদস্তুর বলপ্রয়োগের রাস্তায় পুলিশ এখনও হাঁটেনি। সরকারের তরফে থেকে কোনও চরম বার্তাও দেওয়া হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু— দু’জনেই বুঝিয়েছেন, ওই ঘেরাওয়ে তাঁরা ‘বিরক্ত’। কিন্তু হুঁশিয়ারির সুরে কথা না বলে দু’জনেই সরকারের উপরে আস্থা রাখতে আন্দোলনকারীদের ‘অনুরোধ’ করেছেন।
স্বাস্থ্য ভবনের সামনের অবস্থানও পুলিশ দিয়ে জোর করে তুলে দেয়নি রাজ্য প্রশাসন। বরং সেখানে পুলিশি প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী অবস্থান তুলে নিতে অনুরোধও করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে নিজেই অবস্থানস্থলে পৌঁছেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে দাঁড়িয়েই তিনি আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের আলোচনায় আহ্বান জানিয়েছিলেন।
জুনিয়র চিকিৎসকদের সংগঠনের অন্যতম নেতা কিঞ্জল নন্দ অবশ্য চাকরিহারাদের আন্দোলনকে পুরোপুরি আরজি কর প্রতিবাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে রাজি নন। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের আন্দোলন স্বতন্ত্র। কিন্তু আমরা যে দাবি নিয়ে অবস্থান শুরু করেছিলাম, মানুষ সেগুলোকে সমর্থন করেছিল। তাই আন্দোলনের সঙ্গে যে যে ভাবে পেরেছিলেন জুড়ে গিয়েছিলেন। আচার্য সদনের সামনে যাঁরা আন্দোলনে বসেছেন, তাঁদের দাবির প্রতিও মানুষের সহমর্মিতা রয়েছে। তাই এখানেও তাঁরা একই ভাবে সাহায্য করছেন। তবে দুটো আন্দোলনকে মিলিয়ে দেখছি না।’’
আরও পড়ুন:
বিরোধী রাজনৈতিক শিবির অবশ্য প্রত্যাশিত ভাবেই আচার্য সদনের সামনে স্বাস্থ্য ভবন চত্বরের ছায়াই খুঁজে পাচ্ছে। বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালের কথায়, ‘‘এই আন্দোলনও আরজি কর আন্দোলনের চেহারা নিয়ে নিয়েছে। ব্রাত্য বসু ভাবছেন, এটা তাঁর নাটকের মঞ্চ। তাই রোজ নতুন নতুন নাটক মঞ্চস্থ করছেন। আর মুখ্যমন্ত্রী যে গোটা রাজ্যের সঙ্গে প্রতারণা করছেন, সেটা প্রত্যেকের কাছে পরিষ্কার। তাই আরজি কর কাণ্ডের পরে যেমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, এ বারও সেভাবেই জনরোষ আছড়ে পড়তে চলেছে।’’
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘আমাদের রাজ্যে স্বাস্থ্যক্ষেত্র যে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, সে কথা লোকের কাছে স্পষ্ট। সেই কারণেই আরজি করের ঘটনার পরে সাধারণ মানুষের বিপুল সংখ্যায় আন্দোলনে নেমেছিলেন। এ বার মানুষ বুঝতে পারছেন, শিক্ষাক্ষেত্রকেও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাই এ বারও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মানুষ এই আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছেন।’’ সুজনের কথায়, ‘‘এটা শুধু শিক্ষকদের বিদ্রোহ নয়। মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে একটা গোটা প্রজন্মের ভবিষ্যৎ রক্ষা করার আন্দোলন। এই আন্দোলন যথেষ্ট শক্তিশালী হবে বলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।’’
বিক্ষোভের সমালোচনা করেও শাসক তৃণমূল মেনে নিচ্ছে যে, স্বাস্থ্য ভবন ঘেরাওয়ের মতোই কিছু একটা আচার্য সদনের সামনেও তৈরি করার চেষ্টা চলছে। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের কথায়, ‘‘ওই রকম একটা চেহারা দেওয়ার চেষ্টা তো হচ্ছেই! না হলে সরকারের বিরোধী সব ক’টা অতৃপ্ত আত্মা এক জায়গায় হাজির হয় কী করে?’’ কুণালের কথায়, ‘‘সরকার বার বার বলছে, সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে যাঁদের বেতন দেওয়া সম্ভব, তাঁদের সকলের বেতন চালু রাখা হচ্ছে। সরকার বার বার বলছে, শিক্ষকদের স্বার্থেই রিভিউ পিটিশন করা হয়েছে এবং এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে সেই পিটিশন দুর্বল হয়। তার পরেও রাস্তায় নেমে সরকারকেই নিশানা যারা করছে, তারা তো শিক্ষকদের স্বার্থে কাজ করছে না। অতৃপ্ত আত্মাদের জড়ো হতে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, এই আন্দোলনকে কোথায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।’’
রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু মঙ্গলবার বিবৃতি প্রকাশ করে আন্দোলনকারীদের প্রতি ‘সংহতি’ জানিয়েছেন। বিবৃতিতে লেখা হয়েছে, ‘‘গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াকে দুর্নীতিগ্রস্ত করাই নয়, সেই দুর্নীতিকে আড়াল করতে তালিকা প্রকাশের নামে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে রাজ্য সরকার। অযোগ্যদের কাজে ফিরিয়ে আনার জন্য রাজ্য সরকার বিভিন্ন ধরনের অপকৌশল নিচ্ছে।’’ শিক্ষামন্ত্রী যোগ্য-অযোগ্যদের তালিকা প্রকাশের আশ্বাস দিয়েও কেন পিছু হঠলেন, বিবৃতিতে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বিমানের বিবৃতিতে আরও লেখা হয়েছে, ‘‘বামফ্রন্ট চাকরিহারাদের নিয়ে রাজ্য সরকারের এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতিকে ধিক্কার জানাচ্ছে। এই মিথ্যাচারের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছে।’’
- ২০১৬ সালের এসএসসিতে নিয়োগের পুরো প্যানেল বাতিল করল সুপ্রিম কোর্ট। বলল, পুরো প্রক্রিয়ায় কারচুপি করা হয়েছে। ওই নিয়োগপ্রক্রিয়ার কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।
- এসএসসি-র শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। কলকাতা হাই কোর্ট এই সংক্রান্ত শুনানির পর ২০১৬ সালের সম্পূর্ণ নিয়োগপ্রক্রিয়াই বাতিল করে দিয়েছিল।
- রাজ্যের ২৬ হাজার চাকরি (আদতে ২৫,৭৫২) বাতিল করে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ জানিয়েছে, তিন মাসের মধ্যে নতুন নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
-
আন্দোলনের অন্যতম মুখ চিন্ময় মণ্ডলের নামই বাদ! এসএসসির ‘যোগ্য’ তালিকা দেখে কী বলছেন তিনি?
-
যোগ্য কারা? তালিকা প্রকাশ না করেই ১৮০৩ জন শিক্ষকের নাম বাদ দিয়ে শিক্ষাদফতরে তথ্য পাঠাল এসএসসি
-
‘সাময়িক স্বস্তি’তে এসএসসি এবং শিক্ষা দফতর, আদালত অবমাননা মামলায় কী হল কলকাতা হাই কোর্টে
-
ভিতরে চেয়ারম্যান, এসএসসি অফিসের বাইরে গভীর রাতে আন্দোলনের ঝাঁজ বৃদ্ধি করলেন চাকরিহারারা
-
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশই মানা হবে, ক্লাসে থাকারা নিয়মমতো বেতন পাবেন: এসএসসি