১৯৯৬ সালে জম্মুর শরণার্থী শিবিরে এক কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবার। ফাইল চিত্র
তাঁর ফেসবুকের দেওয়াল আর হোয়াটসঅ্যাপ জুড়ে উপচে পড়ছে অভিনন্দনের ঢেউ! কলকাতার বাঙালি বন্ধুদেরও অনেকে ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ নিয়ে উদ্বেল। এই শহর বা অন্যত্র কাশ্মীরি পণ্ডিতেরা অনেকেই উচ্ছ্বাসে ভাসছেন। তাঁদের এক জন সঞ্জয় কাক তবু ভেবে পাচ্ছেন না এত আনন্দের কারণটা কোথায়?
১৯৯০ সালের সেই সকালটা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন পাঁচতারা হোটেলের কৃতী এগজ়িকিউটিভ শেফ, অধুনা কলকাতার এক নামী হোটেল ম্যানেজমেন্ট সংস্থার বড় কর্তা সঞ্জয়। তখন আঠেরোর সদ্য তরুণ তিনি। কান্নায় ভেঙে পড়া মাকে সঙ্গে নিয়ে এক বস্ত্রে চানপোরায় নিজেদের বাড়ি ছেড়ে চিরকালের মতো অটোরিকশায় উঠে বসেছিলেন। ‘‘আমাদের সঙ্গে সে দিন যা অন্যায় হয়েছিল, এটা কি তার নৈতিক জয় বলবেন? আমি কখনওই এ সব ভেবে খুশি হতে পারব না!’’— বলছেন আজকের মধ্যবয়সি। ৩৭০ থাক বা না থাক, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ফেরার দরজা খুলে গেল, এমন অলীক সম্ভাবনা ধরেও বসে থাকতে রাজি নন তিনি।
সারা দুনিয়ার দেশান্তরী কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিভিন্ন সংগঠনের বিবৃতিতে সোমবার সকাল থেকেই তৃপ্তির সুর। কত পুরনো ক্ষতে যেন মলম পড়ছে। কিছু ভিন্ন স্বর তবু সেই কোরাসে গলা মেলাতে রাজি নন। শেফ সঞ্জয় বলছেন, ‘‘পণ্ডিতদের ৬০ শতাংশই বিদেশে থিতু! আমার মেয়ে কেন কাশ্মীরে ফিরতে চাইবে? অবসরের পরে আমিও হয়তো কলকাতাতেই থেকে যাব।’’ ফেলে আসা শিকড়ের সঙ্গে এই ক’বছরে ঘরছাড়া পণ্ডিতেরা অনেকেই নিজের মতো করে বোঝাপড়া করতে চেয়েছেন।
স্মৃতি: নিখিলেশ মাট্টুর ছবির একটি দৃশ্য।
সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের ছাত্র নিখিলেশ মাট্টু তাঁর পরিবারের অতীত সংযোগ নিয়ে ১২ মিনিটের একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করেছিলেন। উপত্যকা থেকে সপরিবার বাস্তুচ্যুত হয়ে আসার সময়ে তাঁর বয়স সবে এক বছর। ৩৭০ ধারা বিলোপের পরে নিখিলেশও এখন অস্বস্তিতে ভুগছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এর পরিণতি ভাল না খারাপ, কী হল, তা তো সময় বলবে। কিন্তু যে ভাবে এটা ঘটল, তা খুব কষ্টের!’’ প্রায় সামরিক অবরোধের ঢঙে ভূস্বর্গকে মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করেই যেন মূল স্রোতে ফেরানো হচ্ছে বলে হাঁক দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। গোটা পরিস্থিতিটার মধ্যে এক ধরনের প্রহসনের ছোঁয়াচ দেখছেন কাশ্মীরি পণ্ডিত নাগরিকদের একাংশও।
শ্রীনগরের প্রবীণ সাংবাদিক জগরনাথ রায়নার নাতি কলহন রায়নাও কলকাতার এসআরএফটিআই-এর ছাত্র। ভূস্বর্গ বলতে তাঁর কাছে দাদু-ঠাকুরমা-পিসিদের কোলে কিছু হলদেটে আলোকচিত্র। তবে বড় হয়ে জঙ্গিদের কাছ থেকে আসা তাঁদের পরিবারকে লেখা ‘হুমকি-চিঠি’টা কলহনও দেখেছেন। ‘‘তাতে কী? দুনিয়াময় বিভিন্ন প্রজন্মেই এমন হিংসার ইতিহাস রয়েছে। আমি ও সব ঘৃণার বোঝা টানতে রাজি নই।’’— বলছেন একুশ শতকীয় তরুণ। কলহনের মা-বাবা পুণেয় থিতু হয়েছিলেন। নিছকই পণ্ডিত পরিচয়ের তকমা বহনে গররাজি কলহন বলছেন, ‘‘আগে কী হয়েছে না ভেবে আমি এখন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়েই শঙ্কিত।’’ ৩৭০ নিয়ে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উচ্ছ্বাসেই বরং অস্বস্তিতে তরুণ। তাঁর আশঙ্কা, ‘‘কাশ্মীর নিয়ে একতরফা সিদ্ধান্তের পরে অন্য রাজ্যগুলির উপরেও গোলমেলে ফতোয়া চাপানোর ভয় পাচ্ছি।’’
’৯০-এর উত্তাল সময়ে পুঞ্চে কর্মরত সেনা মেজরের পুত্র সঞ্জয়ও ভূস্বর্গের সুখস্মৃতিগুলিই মনে রাখতে চান। পরে গিয়ে দেখেছেন, তাঁদের পৈতৃক বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছে কাছের জঙ্গিধ্বস্ত গ্রামের একটি মুসলিম পরিবার। ‘‘উপত্যকায় সকলে নিরাপদে থাক! পরিস্থিতি যেন হাতের বাইরে না-বেরোয়, এর বেশি কিছু ভাবতে পারছি না।’’— বলছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy