কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছনোর পর স্বাগত জানানো হচ্ছে দেবাশিস বিশ্বাস-সহ অন্যান্য অভিযাত্রীকে। মঙ্গলবার শৌভিক দের তোলা ছবি।
এক বার নয়, দু’বার নয়। তিন তিন বার ফিরিয়েছে সাগরমাতা। তিন বারই তুষার ধসের ধোঁয়ায় ঢেকেছে স্বপ্ন। কিন্তু ফের মাথাচাড়া দিতে সময় লাগেনি মোটে। ব্যারাকপুরের বাসিন্দা, পেশায় কলকাতা পুলিশের কর্মী গৌতম ঘোষের স্ত্রী চন্দনা বিমানবন্দরে বসে বলছিলেন, ২০০৯ সালে যখন ক্যাম্প টু থেকে ফিরতে হয়েছিল, তখনই গৌতম ঠিক করে নিয়েছিলেন ফের যাবেন এভারেস্ট অভিযানে।
টাকা জোগাড় হয় পাঁচ বছর পরে, ২০১৪ সালে। কিন্তু খুম্বু আইসফলে দুর্ঘটনায় অভিযান বাতিল হয়ে যাওয়ায় বেস ক্যাম্প থেকেই ফেরার পথ ধরতে হয়। এ বছর ফের চেষ্টা। কিন্তু প্রকৃতি প্রসন্ন হল না এ বারও। চোখের সামনে তুষার ধসের ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে ফিরতে হল এক রাশ আতঙ্ক সঙ্গে নিয়ে। কলকাতা পৌঁছতে পৌঁছতেই অবশ্য আতঙ্ক কাটিয়ে ফের আত্মবিশ্বাসী গৌতম। টাকা জোগাড় হলে ফের যাবেন স্বপ্নশৃঙ্গ ছুঁতে। হাসিমুখে স্ত্রী চন্দনা বললেন, ‘‘ওঁর স্বপ্নটাই আমার স্বপ্ন। আমি ভয় পেয়ে গেলে ওকে সাহস জোগাব কী করে!’’ আর নবম শ্রেণির ছাত্র, ছেলে দেবাঞ্জন ভারিক্কি স্বরে বলল, ‘‘সব কিছু জেনেই তো বাবাকে পাঠাই, ভয়-টয় লাগে না।’’
মঙ্গলবার বিকেলে কলকাতা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলেন এভারেস্ট অভিযানের দশ অভিযাত্রী। চো য়ু শৃঙ্গ অভিযান থেকে ফিরলেন এভারেস্ট-কাঞ্চনজঙ্ঘা-অন্নপূর্ণা-জয়ী দেবাশিস বিশ্বাসও। সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তিন প্রতিনিধি রাজীব ভট্টাচার্য, দেবদাস নন্দী ও বিপ্লব বৈদ্য— সকলেই পর্বতারোহী। সবাইকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন রাজ্য সরকারের যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও।
সোনারপুরের রুদ্রপ্রসাদ হালদার বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই বছর দেড়েকের মেয়েটিকে কোলে নিয়ে বললেন, ‘‘আমার পরিবারই আমার অনুপ্রেরণা। আজ পারিনি, কাল ঠিক পারব এভারেস্ট ছুঁতে।’’ স্ত্রী রীতার কথায়, ‘‘বেঁচে ফিরেছে, এটাই বড় ব্যাপার। তবে আমি জানি, সব কিছুর পরেও ও আবার যাবে।’’ একই সুর হরিদেবপুরের অভিযাত্রী সত্যরূপ সিদ্ধান্তের মা গায়ত্রী দেবীর গলায়ও। সাফ বললেন, ‘‘ছেলের নেশা যে কিছুতেই কাটার নয়, সেটা জানি। তাই আবার বিপদে পড়তে পারে জেনেও, পরের বার একই ভাবে সমর্থন করব ওকে।’’
কসবার সৌরভসিঞ্চন মণ্ডলের দাদা সনৎ বিশ্বাসের গলায় আবার একটু শাসনের সুর। জানালেন, পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার পর এ সব এড়িয়ে চলাই ভাল। সৌরভের মা, স্ত্রী ভীষণ দুশ্চিন্তায় থাকেন। বিপদের মুখে না যেতেই বলেন সবাই। কিন্তু একই সঙ্গে সনতের আফশোস, ‘‘বললেই বা শুনছে কে!’’ এ বছরের অভিযাত্রীদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠা জ্যোৎস্না শেঠের দিদি বন্দনা সিংহ আবার বললেন, ‘‘ভাগ্যে থাকলে তো ঘরে বসেও বিপদ হবে। ও অন্য রকম কিছু করুক, সেটাই আমরা চাই।’’
বারাসতের সুনীতা হাজরা অবশ্য দু’বছরের দুর্ঘটনা চোখের সামনে দেখে বাস্তবটা অন্য ভাবে অনুভব করেছেন। বললেন, ‘‘জীবন বাজি রেখেও এভারেস্ট চড়তে হবে, এমন মোহ আমার নেই। সব রকম পরিস্থিতি যদি আবার অনুকূল হয়, তবেই ফের যাওয়ার কথা ভাবব।’’ সুনীতার স্বামী সুদেবও জানিয়ে দিলেন, স্ত্রী যেমনটা চাইবেন, তেমন ভাবেই পাশে থাকবেন তিনি। পরের বার হলে পরের বার, নয়তো অন্য কোনও বার।
চো য়ু অভিযানে গিয়ে গলার সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন দেবাশিস বিশ্বাস। জানালেন, ভূমিকম্পের আঁচ পাওয়া গিয়েছিল ওখানেও। তবে এভারেস্টের মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুর্ঘটনার আশঙ্কায় অভিযান বাতিল করে দেয় চিন সরকার। তাই অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্প পর্যন্ত এগিয়েও ফিরতে হয় দেবাশিসকে।
এভারেস্ট অভিযান থেকে এখনও ফেরেননি বাংলার তিন অভিযাত্রী দেবরাজ দত্ত, প্রদীপ সাহু ও চেতনা সাহু। আগামী কাল কাঠমান্ডু পৌঁছনোর কথা তাঁদের। অন্নপূর্ণা অভিযান থেকে ফেরেননি দীপঙ্কর ঘোষও। তবে তাঁদের অভিযানও বাতিল হয়ে গিয়েছে গত সপ্তাহেই।
ফিরে আসার যন্ত্রণা আছে, কিন্তু আবার অভিযানে যাওয়ার আত্মবিশ্বাসও আছে। আর সেই সঙ্গেই সমস্ত আরোহীর আশঙ্কা, আবারও এত টাকা জোগাড় হবে কি না। মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস অবশ্য সকলকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘‘পর্বতারোহীদের সব রকম ভাবে সাহায্য করবে রাজ্য সরকার।’’ এভারেস্ট অভিযানে রয়্যালটি বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ নেপাল সরকারকে দিতে হয়। তার মেয়াদ বাড়ানো যায় কি না, সে বিষয়েও নেপাল সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলে আশ্বাস দিলেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy