ট্রাম স্টপ বলে কিছু নেই। রাস্তার মাঝে প্রাণ হাতে নিয়েই ওঠানামা। বুধবার রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে ছবিটি তুলেছেন বিশ্বনাথ বণিক।
মূক ও বধির এক তরুণীর মর্মান্তিক মৃত্যুতে শেষমেশ টনক নড়ল রাজ্য পরিবহণ দফতরের। এ শহরে ট্রামে ওঠা-নামা যে আসলে মরণফাঁদ, তা কার্যত মেনে নিলেন দফতরের কর্তারা। কী ভাবে এই বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, তা খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি তৈরি করল রাজ্য সরকার। সেই সঙ্গে, মঙ্গলবার দেশপ্রিয় পার্কের দুর্ঘটনায় ট্রামচালক এবং দুই কন্ডাক্টরের যে গাফিলতি ছিল, তা-ও প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসায় তিন জনকেই এ দিন সাসপেন্ড করা হয়েছে। পথচারীদের সম্মিলিত চিৎকার শুনে এবং ওই তরুণী ট্রামের তলায় চলে গিয়েছেন দেখেও চালক কেন ট্রাম থামালেন না, সে প্রশ্ন উঠেছিল মঙ্গলবারই।
এ শহরে ট্রামলাইন মরণফাঁদ হয়ে ওঠার ঘটনা নতুন নয়। পরিবহণ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, বছর দশেক ধরেই ধাপে ধাপে কলকাতা শহরের সমস্ত ট্রামলাইনই যাত্রীদের ওঠা-নামার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এক পরিবহণকর্তা বলেন, ‘‘ট্রামলাইন কংক্রিট করার কাজ শুরু হয় বাম আমলেই। তার আগে পর্যন্ত ট্রামলাইন ছিল সংরক্ষিত। রাস্তার মাঝখানে হওয়া সত্ত্বেও উঁচু বুলেভার্ড দিয়ে তা আলাদা করা থাকত। বুলেভার্ডে যাত্রীরা নিরাপদে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন। ট্রাম থেকে ওঠা-নামাও করতে পারতেন।’’
ওই কর্তা জানিয়েছেন, কংক্রিট করার কাজ শুরু হতেই সংরক্ষিত এলাকা তুলে দেওয়া হয়। রাস্তা চওড়া করতে ট্রামলাইনের দু’পাশের জায়গাও ছেঁটে ফেলা হয়। কিন্তু লাইন রয়ে যায় রাস্তার মাঝখানেই। ফলে, ট্রামে উঠতে গেলে দ্রুত গতিতে আসা গাড়ি এড়িয়েই যাত্রীদের কার্যত রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অথবা, রাস্তার মাঝখানে ট্রাম থেকে নেমেই যাত্রীদের গাড়ির মুখোমুখি পড়ে যেতে হয়। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ওঠা-নামা করতে হয় ট্রামে।
ফলে, অনেক সময়েই ট্রাম থেকে নামা-ওঠার সময়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায়। মাস ছয়েক আগে টালিগঞ্জ থানার কাছে এমনই এক দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হন এক প্রৌঢ়া। মঙ্গলবারের দুর্ঘটনা আরও মর্মান্তিক। ওই দিন সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ও লেক ভিউ রোডের মোড়ে ট্রামলাইনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলেন মূক ও বধির তরুণী জ্যোতি সিংহ। পিছন থেকে আসা একটি ট্রামের নাগাড়ে দিয়ে যাওয়া ঘণ্টি বা আশপাশের লোকজনের চিৎকার— কিছুই শুনতে পাননি ২৩ বছরের ওই তরুণী। ঘাড়ের উপরে এসে পড়ে ট্রামটি। প্রায় ফুট দশেক ওই তরুণীকে হেঁচড়ে নিয়ে যায় সেটি। গুরুতর জখম অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও জ্যোতিকে বাঁচানো যায়নি।
রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘পথ-নিরাপত্তা বাড়াতে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য জুড়ে ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ প্রকল্প শুরু করেছেন। সেখানে খাস কলকাতা শহরে এমন বিপজ্জনক ট্রামলাইন সরকারের পক্ষে যথেষ্ট অস্বস্তির। মঙ্গলবারের দুর্ঘটনা সেটাই আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।’’ স্বভাবতই ওই ঘটনার পরে নড়ে বসেছেন পরিবহণ দফতরের কর্তারা। নির্দিষ্ট জায়গায় ট্রামের স্টপ থাকলেও তা যে যাত্রীদের জন্য যথেষ্ট বিপজ্জনক, তা নিয়ে একমত তাবড় পরিবহণ-কর্তারা। এর পরেই পাঁচ সদস্যের কমিটি তৈরি করে নিরাপদ ট্রামযাত্রার উপায় খুঁজে বার করতে চাইছে পরিবহণ দফতর।
‘হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশনার্স’ (এইচআরবিসি)-এর ভাইস চেয়ারম্যান সাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৈরি ওই কমিটির সদস্য হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ পরিবহণ পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগমের মুখ্য ট্র্যাফিক ইঞ্জিনিয়ার অনুপ চট্টোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ পরিবহণ নিগমের মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার প্রবীরকুমার মিত্র। এ ছাড়াও কমিটিতে কলকাতা পুলিশের এক কর্তা ও দিল্লির পরিবহণ সংক্রান্ত সংস্থা ডিআইএমটিএস-এর এক প্রতিনিধি যুক্ত হবেন বলে পরিবহণ দফতর সূত্রে খবর। কলকাতায় ২৪টি ট্রাম রুট রয়েছে। প্রতিটি রুট সমীক্ষা করে ওই কমিটিকে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy