Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

থিমের চেনা ছক ভেঙে নতুন ভাবনার প্রকাশ

নব্বইয়ের মাঝামাঝি সাবেকিয়ানার বাঁধা গত থেকে বেরিয়ে এসেছিল মহানগরের পুজো। থিম পুজোকে হাতিয়ার করে শুরু হয়েছিল উৎসব কাপ। এ বার থিমের বাঁধা গত থেকেও বেরিয়ে আসছে পুজোগুলি। অন্য ধরনের ভাবনায় তুলে ধরছে নিজেদের।

রঙের হাতেখড়ি। সোমবার, কালীঘাটে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

রঙের হাতেখড়ি। সোমবার, কালীঘাটে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:০৭
Share: Save:

নব্বইয়ের মাঝামাঝি সাবেকিয়ানার বাঁধা গত থেকে বেরিয়ে এসেছিল মহানগরের পুজো। থিম পুজোকে হাতিয়ার করে শুরু হয়েছিল উৎসব কাপ। এ বার থিমের বাঁধা গত থেকেও বেরিয়ে আসছে পুজোগুলি। অন্য ধরনের ভাবনায় তুলে ধরছে নিজেদের।

জীবনের বাঁধা গতে সম্পর্ককে ধরে রাখতে দরকার অদৃশ্য ‘ফ্রেম’। সেই ফ্রেমকে এ বার দৃশ্যমান করে তুলছে দক্ষিণ কলকাতার শিবমন্দির পুজো কমিটি। আর তাতে নিত্য দিনের পরিচিত জিনিসকেই সাজিয়ে রাখছেন শিল্পী বিমল সামন্ত। শিবমন্দিরের মণ্ডপে এ বার কাঠের ছড়াছড়ি! কাঠের খুন্তি, হাতা, ডালের কাঁটা, ক্রিকেট ব্যাট, ক্যারম বোর্ড, এমনকী লেটার বক্সও তুলে এনেছেন শিল্পী। ফ্রেমের মধ্যে সেগুলিকে সাজিয়ে গড়ে তুলছেন মণ্ডপের অন্দরভাগ। শিবমন্দিরের প্রতিমাও এ বার কাঠের! সপরিবার মা দুর্গাও সেখানে ফ্রেমবন্দি!

অন্য রকম ফ্রেমবন্দি এ বার গরফার পূর্বাচল শক্তি সঙ্ঘও! শিল্পী রবীন রায় সেখানে তুলে ধরছেন শিল্প, সভ্যতা, কলকাতা মায় পুজোর বিবর্তনকে। গোটা কর্মকাণ্ড সিনেমার শ্যুটিংয়ের মতো ক্যামেরাবন্দি করেছেন তরুণ পরিচালক সৌরিশ দে। পরে তা ছাড়া হবে সোশ্যাল মিডিয়ায়। পুজো কমিটির সভাপতি অরিজিৎ দাসঠাকুর জানালেন, ওড়িশার বালুশিল্পী মানস সাউও জুড়ে রয়েছেন এই পুজোর সঙ্গে। ওড়িশায় বসে তিনি বালির উপরে সৃষ্টি থেকে শুরু করে কলকাতার পুজোর বিবর্তন এঁকে দেখিয়েছেন অ্যানিমেশনের ধাঁচে। সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করা হয়েছে। মণ্ডপের ভিতরে রাখা এলইডি টিভিতে সেই অ্যানিমেশনও দেখবেন দর্শকেরা।

অন্য ধারার থিমে এ বার নজর কাড়তে পারে বেলেঘাটা ৩৩ পল্লি। সেখানে থিমের উপকরণ হিসেবে বাছা হয়েছে কলকাতার হলুদ-কালো ট্যাক্সিকে। পুজোকর্তারা বলছেন, কলকাতার নস্ট্যালজিয়ার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে ট্যাক্সি। তাই মণ্ডপ সাজাতে ট্যাক্সির কাঠামোকে হাজির করছেন শিল্পী শিবশঙ্কর দাস। কলকাতার ট্যাক্সি যদি থাকে, তা হলে যানজটও থাকবে। আমজনতা যতই বিরক্ত হোন না কেন, ৩৩ পল্লির মণ্ডপে যানজটকেও নতুন আঙ্গিকে পেশ করছেন শিবশঙ্কর। পুজোকর্তাদের আশা, নতুন ধরনের থিম দেখতে দর্শক উপচে পড়বে। বেলেঘাটায় তৈরি হবে আসল যানজট।

শিল্পী পূর্ণেন্দু দে-র হাত ধরে এ বার কলকাতার বিবর্তন উঠে আসছে দক্ষিণ কলকাতার ৬৬ পল্লির পুজোমণ্ডপেও। সেখানকার পুজো কর্তারা বলছেন, কলকাতা মানেই প্যাশন। সেই প্যাশনের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে টানা রিকশা, পুরনো অলিগলি, জমিদারবাড়ির মতো নস্ট্যালজিয়া। উৎসব কাপের লড়াইয়ে দর্শক টানতে সেই সব নস্ট্যালজিয়াই ফিরে আসছে শিল্পীর তুলিতে। প্রতিবেশী বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘে এ বার শিল্প ফুটে উঠছে ঢিল-সুতোয়। সুতোয় ঢিল বেঁধে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে মণ্ডপ সাজাচ্ছেন শিল্পী অনির্বাণ দাস।

আয়নাকে নতুন ভাবে মণ্ডপসজ্জায় নিয়ে আসছে ভবানীপুর ৭৫ পল্লি। থিমের নাম ‘আরশিনগর’। আয়না দিয়ে তৈরি মণ্ডপে ঢুকতে গেলে দর্শকেরা তাঁদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবেন। মূল মণ্ডপের উপরে থাকছে কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি হাতিও। মণ্ডপে থাকছে নানা রাজ্যের হাতের কাজ। ৭৫ পল্লির কর্তারা বলছেন, চমক জাগাতে মণ্ডপের ভিতরে ৮ ফুট ৯ ইঞ্চির সেন্ট টেরেসার মূর্তি থাকছে। তাকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে সেলফি জোন। বাঘা যতীন রবীন্দ্র পল্লির পুজোয় এ বার থিম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে মাদাম তুসোর মিউজিয়ামকে। সেখানও থাকছে সেলফি জোন।

নস্ট্যালজিয়ার পাশাপাশি এ বার কলকাতার উৎসব কাপে উঠে আসছে স্বপ্নের দুনিয়াও। ভবানীপুরের অবসর ক্লাবে গত বছর উপজাতির শিল্প গড়ে তাক লাগিয়েছিলেন ‘ঘরের ছেলে’ গৌরাঙ্গ কুইল্যা। এ বছর গৌরাঙ্গর হাত ধরে সেখানে গড়ে উঠছে পরির দেশ। মণ্ডপসজ্জার উপাদান হিসেবে কাগজ, থার্মোকল, মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। সঙ্গে থাকছে নরম শেডের রং। থিমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুর্গাকেও পরির মতো করেই তৈরি করা হচ্ছে। অবসরের পুজোকর্তা শ্যামল নাগদাস বলছেন, ‘‘বাইরের ঝলমলে দুনিয়া থেকে মণ্ডপের ভিতরে ঢুকলেই স্বপ্নের দুনিয়ায় এসে পড়বেন দর্শকেরা।’’

স্বপ্নের দুনিয়া এ বার উঠে আসছে বাগমারি বাজারের কাছে ১৪-র পল্লির মণ্ডপেও। বাগমারি ব্রিজ লাগোয়া এই পুজোর থিম ‘সাঁঝবাতির রূপকথারা’। পুজো ময়দানের নতুন শিল্পী মিঠুন দত্ত সেখানে ছোটদের স্বপ্নের দুনিয়ার পরি, পক্ষীরাজ ঘোড়া তুলে ধরতে প্লাইউড, টেরাকোটার ঘোড়া, পেন্টিং ব্যবহার করছেন। ঠাকুরের সাজে থাকছে বিশেষ ধরনের ঝুড়ি এবং সিন্থেটিক কাগজ।

উৎসবের আলোর থিম তৈরিতে সত্যিকারের সাঁঝবাতি নিয়ে এসেছে পূর্ব কলকাতার স্বপ্নার বাগান পুজো কমিটি। শিল্লী অমিত এবং অরিন্দমের হাত ধরে সেখানে মণ্ডপ তৈরি হয়েছে সাঁঝবাতি দিয়ে। ব্যবহার করা হয়েছে সাইকেলের নানা অংশও। মণ্ডপের ভিতরে উৎসবের আবহ তৈরি করতে পুরনো দিনের সাঁঝবাতির আলোই থাকছে। মায়াবি পরিবেশ তৈরি করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্রিস্টালও।

উল্টোডাঙার পল্লিশ্রীতে ঢুকে তাজ্জব বনে যেতেই পারেন দর্শকেরা। উৎসবের থিম তৈরি করতে সেখানে এলাকার বাড়িগুলিকেই নতুন ভাবে সাজিয়ে তুলছেন শিল্পী মানস। থাকছে নানা ধরনের পশুপাখি, কীটপতঙ্গের মোটিফ। পুড়ো পাড়াটাই একটা ‘ইনস্টলেশন আর্ট’ হিসেবে গড়ে উঠছে সেখানে।

থিমের নতুনত্বে চটকদারি থাকছে উত্তর কলকাতার সিকদার বাগানেও। নবীন শিল্পী সুজিত লাল সেখানে তুলে ধরছেন বিভিন্ন দেবতার তেজে দেবতার জন্ম এবং ১৭ দিন ধরে তাঁর অসুরের সঙ্গে যুদ্ধকে। যুদ্ধের পরে দেবী দুর্গা যে শতবর্ষব্যাপী ধ্যানে বসেছিলেন, তা-ও ফুটিয়ে তুলছেন তিনি। মণ্ডপসজ্জায় চমক আনতে নতুন ধরনের কাপড় (নন-উভেন ফেব্রিক) ব্যবহার করা হচ্ছে। থাকছে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল ও মুলিবাঁশ। সাবেকি পুজোয় চমক দিতে থিমের ফিউশন যোগ করছে গড়িয়া মিতালি সঙ্ঘ। শিল্পী বাপাই সেন সেখানে মণ্ডপসজ্জায় প্রদীপ, লণ্ঠনের পাশাপাশি নিয়ে এসেছেন এলইডি আলোকেও। মিতালি-র নবদুর্গার সাবেকিয়ানায় অবশ্য কোনও বদল ঘটেনি। মণ্ডপসজ্জার উপাদানে বদল এনে চমক জাগাতে চাইছে কাঁকুড়গাছি মিতালি সঙ্ঘও। শিল্পী সৌরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় মণ্ডপকে তৈরি করছেন উপাসনা গৃহের আদলে। মণ্ডপসজ্জায় ব্যবহার করছেন কোষাকুষি, ধূপদানির মতো নানা উপাদান।

নতুনত্বের অভাব নেই। দর্শকেরা এ বার কী বলেন, তারই অপেক্ষায় পুজোকর্তা ও শিল্পীরা!

অন্য বিষয়গুলি:

theme pujo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE