Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

সমস্ত দিক থেকেই এক জন প্রকৃত গুরু

অজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

মানুষের জ্ঞান থাকে, কিন্তু সেই জ্ঞান প্রকাশ করার ক্ষমতা সবার থাকে না। আমরা যাঁর কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করি, জ্ঞান সঞ্চয় করি, তিনি তো গুরু। আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ছিলেন সমস্ত দিক থেকেই এক জন প্রকৃত গুরু। আমি ওঁর শুধু ছাত্র নই, ছিলাম সব কিছুই। গুরুজি লিখেছেন, ‘ঠাকুর রামকৃষ্ণের জীবনে যেমন স্বামী বিবেকানন্দ, আমার জীবনে তেমনই অজয়।’

আমি সারা জীবন সেই লোকটাকে খুঁজে বেড়িয়েছি, যিনি ম্যাচ চলাকালীন প্রথম ডিভিশনে খেলা ফুটবল খেলোয়াড় জ্ঞানপ্রকাশের চোখে লাথি মেরেছিলেন। দেখা হলে আমি তার পায়ে ‘ডাইভ’ দিতাম। এই লোকটি না-থাকলে আমরা কখনওই ভারতীয় সঙ্গীতের কাণ্ডারি হিসেবে গুরুজিকে পেতাম না।

একটা সময় ছিল, যখন বারাণসী থেকে তবলিয়া না-এলে রাগসঙ্গীতের আসর হত না। কারণ, তখন কলকাতায় তবলার প্রায় চল ছিল না। শিক্ষিত সমাজে তবলার সমাদরও ছিল না। তার পর আস্তে আস্তে কলকাতা তবলায় উন্নত জায়গা করে নিল। এবং সেটা গুরুজির হাত ধরেই। মসীত খান কলকাতায় থাকতেন। তাঁর সুযোগ্য ছাত্র জ্ঞানপ্রকাশ। তাঁর ছাত্র আবার শঙ্কর ঘোষ। সেখান থেকে বিক্রম এবং মল্লার ঘোষের হাত ধরে এখনকার ছাত্রছাত্রীরা। তিন প্রজন্ম হলে সেই কাজকে একটা ঘরানা বলে ধরে নেওয়া হয়। গুরুজির ক্ষেত্রে তো প্রায় পাঁচ প্রজন্ম হয়ে গেল। কাজেই তবলার ‘কলকাতা ঘরানা’র স্রষ্টা হিসেবে আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষকে স্বীকার না করে কোনও উপায় নেই।

রবীন্দ্রনাথের বিশেষ ভক্ত হয়েও বাংলা সাহিত্যের প্রায় সকল লেখকের বই পড়তেন। পড়তেন ইংরেজি লেখাও। অসামান্য ইংরেজি লিখতেন। শুধু তাই নয়, ইংরেজি ভাষায় ভারতীয় রাগসঙ্গীতের কম্পোজিশনও করেছেন গুরুজি। বিদেশি ভাষায় ভারতীয় রাগসঙ্গীতের প্রসার এবং প্রচারের জন্য তিনি এই কাজ করেছিলেন। গুরুজির এই কাজে আমারও ভীষণ আগ্রহ ছিল। তিনি কয়েক হাজার গানের রচয়িতা। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, রঘুনাথ পানিগ্রাহী, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, বাণী কোনার, তণিমা ঠাকুর, আমি নিজে, এ ছাড়া তবলার প্রায় সকলে— এত সফল ছাত্রছাত্রী বোধ হয় ভারতবর্ষের আর কোনও গুরু পাননি। সে দিক থেকে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গুরু বললে অত্যুক্তি হবে না। গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত আমার প্রথম দু’টি ‘লং প্লেয়িং রেকর্ড’-এর সমস্ত গানই গুরুজির লেখা ও সুর করা। পরে গুরুজির অগনিত বাংলা এবং হিন্দি গান গেয়েছি, রেকর্ডও করেছি।

গুরুজির আদর্শ ছিল, অন্যকে শ্রদ্ধা করা। অন্যের কাছ থেকে গ্রহণ করা। তিনি বলতেন, ঘরানার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে সারা পৃথিবীকে ঘর বানাও। অন্যকে শ্রদ্ধা না করলে, বড় মানুষ হওয়া যায় না। তিনি তাঁর সমস্ত ছাত্রের বরাবর ভীষণ প্রশংসা করতেন। তার ফলে প্রত্যেক ছাত্রই তার সেরা ‘পারফরম্যান্স’ দেওয়ার চেষ্টা করত। গুরুজি বলতেন, ‘সঙ্গীতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধের মধ্যে সঙ্গীতের সাফল্য লুকিয়ে নেই। আসল কথা মনুষ্যত্ব। মানুষ হওয়া।’ আসলে ভারতীয় দর্শনের মূল কথাগুলি গুরুজি তাঁর গান রচনার মধ্য দিয়ে বলে গিয়েছেন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE