কলকাতা হাইকোর্ট ‘নারদ স্টিং অপারেশন’ নিয়ে রাজ্য সরকারের ঘোষিত তদন্তকে বিশেষ আমল দিতে চায়নি। তবে সরকারের তরফে ওই তদন্তে নারদ নিউজের কর্ণধার ম্যাথু স্যামুয়েলকে এ বার জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় লালবাজার। অবিলম্বে তাঁকে লালবাজারে হাজির হতে বলে ইতিমধ্যে ই-মেলও পাঠিয়ে দিয়েছেন কলকাতা পুলিশের কর্তারা।
রাজ্যের বিভিন্ন নেতানেত্রী দেদার টাকা নিচ্ছেন, ভিডিওয় তোলা এমন ছবি দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ম্যাথুর নারদ নিউজ। তাদের প্রকাশিত ভিডিও নিয়ে ভোটের আগে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশ জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। নির্বাচনের মুখে দুর্দান্ত হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছে ভেবে উল্লসিত হয়ে ওঠে বিরোধী শিবির। হুল-বিদ্ধ নেতানেত্রীদের ভোটে লড়তে দেওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে শুরু হয় তরজা। সেই ভিডিও নিয়ে হাইকোর্টে মামলা চলছে। হাইকোর্ট ওই ফুটেজ ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য হায়দরাবাদের ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে দিয়েছে। আজ, শুক্রবার দুপুরেই সেই মামলার শুনানি রয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের ডিভিশন বেঞ্চে। সরকারের তদন্ত প্রসঙ্গে আগের দিন ওই মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, ‘‘কে কী করছে বা বলছে, সেটা বড় কথা নয়। এই নিয়ে ডিভিশন বেঞ্চ যে-রায় দেবে, সেটাই শেষ কথা। কারও আপত্তি থাকলে আদালতের রাস্তা খোলা আছে।’’
নারদ-হুল নিয়ে সরকারি তদন্তের বিষয়টি উচ্চ আদালতে তেমন গুরুত্ব না-পেলেও খোদ পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বাধীন তদন্ত দল বসে নেই। লালবাজারের খবর, নারদ নিউজের সিইও ম্যাথুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে খোঁজখবর শুরু হয়েছে। স্টিং অপারেশনে বিভিন্ন নেতানেত্রীকে বিপুল পরিমাণ টাকা দেওয়া হচ্ছে বলে যে-ছবি দেখানো হয়েছে, তা যদি সত্যি হয়, নারদ-প্রধান অত অর্থ কোথা থেকে পেলেন— ওঠে সেই প্রশ্নও। পুলিশি তদন্তে সেটাও যাচাই করা হবে। সেই সূত্রেই ম্যাথুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সবিস্তার বিবরণ জানতে চাইছে পুলিশ। কে ইউটিউবে নারদ নিউজের স্টিং ভিডিও আপলোড করেছিল, তা-ও জানার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। সম্প্রতি নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, নারদ নিউজের স্টিং অপারেশন নিয়ে আলাদা তদন্তে নামছে রাজ্য সরকার। নারদ-হুলে বিদ্ধ নেতানেত্রীদের কার্যত ক্লিনচিট দিয়ে দলীয় কর্মশালায় মমতা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সরকারি তদন্ত মানে ঘুষ নেওয়ার তদন্ত নয়। তদন্তটা হবে ঘুষ দেওয়ার নেপথ্যের চক্রান্ত নিয়েই। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে তৃণমূলের সভায় মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ তোলেন, ব্ল্যাকমেলিংয়ের রাস্তা নিয়েছেন ম্যাথু। সেই মন্তব্যে মমতার তরফে পুলিশি তদন্ত প্রভাবিত করার ইঙ্গিত দেখতে পেয়েছেন রাজনৈতিক বিরোধীদের একাংশ। ওই শিবিরের অনেকের মতে, নারদের হুল তথা ম্যাথু-তদন্তে ঠিক কী ভাবে এগোতে হবে, এই মন্তব্য করে কার্যত সেই অভিমুখ বাতলে দিতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীই।
উচ্চ আদালত বা বিরোধী শিবিরের মন্তব্যে অবশ্য গোয়েন্দা তদন্তের গতি ব্যাহত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। লালবাজার সূত্রে জানা গিয়েছে, নারদ বা ম্যাথু সম্পর্কে পুরোদমে তথ্য জোগাড় করা হচ্ছে। নারদের হুল-অভিযান নিয়ে মামলা হওয়ার পরে কলকাতা পুলিশের তরফে কয়েক বার ম্যাথুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, খোদ নারদ-প্রধানের মুখ থেকে পুরো বিষয়টি জেনে নেওয়া। কিন্তু কোনও ভাবেই ম্যাথুর নাগাল পাওয়া যায়নি। তার পরে নারদ নিউজের ওয়েবসাইটে থাকা ম্যাথুর একটি ই-মেল আইডি-র সন্ধান পায় পুলিশ। সেই ই-মেলেই চিঠি পাঠিয়ে ম্যাথুকে কলকাতা পুলিশের অর্থনৈতিক অপরাধ দমন শাখার সহকারী কমিশনারের সামনে হাজির হতে বলেছে লালবাজার। ম্যাথুর তরফে কোনও উত্তর মিলেছে কি না, সেই ব্যাপারে অবশ্য মুখ খুলতে চাননি পুলিশকর্তারা। বৃহস্পতিবার ম্যাথুর মোবাইলে ফোন করা হলে কোনও সাড়া মেলেনি।
বিধানসভা ভোটের আগে নারদ নিউজ স্টিং অপারেশনের যে-ভিডিও প্রকাশ করেছিল, তাতে টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল শাসক দলের চার মন্ত্রী এবং চার জন সাংসদকে। আনন্দবাজার সেই ফুটেজের সত্যতা পরীক্ষা করতে পারেনি। ম্যাথুর দাবি ছিল, ভিডিও ফুটেজের সত্যতা যাচাইয়ে তিনি যে-কোনও ধরনের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত। নারদ ফুটেজ সামনে আসার পর থেকে তৃণমূল অবশ্য বারে বারেই এর পিছনে ষড়যন্ত্রের কথা বলে আসছে। ফুটেজের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে তারা। বিধানসভা ভোটে জিতে ফের ক্ষমতায় আসার পরে নারদ নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন মমতা। তদন্ত দলের মাথায় বসানো হয় কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে।
মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পরে কলকাতার মেয়র ও মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়ের (নারদ নিউজের ফুটেজে দেখা গিয়েছিল তাঁকেও) স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায় গত রবিবার নিউ মার্কেট থানায় নারদ নিউজের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তার ভিত্তিতে জালিয়াতি, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র-সহ চারটি ধারায় মামলা রুজু হয়েছে।
নারদের স্টিং অপারেশন নিয়ে যে-মামলা হয়েছে, তাতে নির্দিষ্ট কারও নাম নেই বলে পুলিশি সূত্রে জানা গিয়েছে। অভিযুক্ত হিসেবে নারদ নিউজের কয়েক জন কর্তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই মামলায়। তবে ম্যাথু গোড়া থেকেই নারদ ফুটেজ প্রকাশ এবং তার পক্ষে কথা বলে আসছেন, তিনি নিজেই এই স্টিং অপারেশন করেছেন বলে দাবি করেছেন। তাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকেই ডেকে পাঠানো হয়েছে।
নারদ-কর্ণধারকে পুলিশ জেরা করতে পারে কি না, মেয়র-পত্নীর লিখিত অভিযোগ দায়ের করার দিন থেকেই সেই বিষয়ে জোর জল্পনা চলছিল। সে-ক্ষেত্রে ম্যাথুর তরফে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, সেটাও জল্পনার অন্যতম প্রসঙ্গ হয়ে উঠছিল। সেই সময় দুবাইয়ে ছিলেন ম্যাথু। ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানিয়েছিলেন, দেশে ফিরে নিজের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু লালবাজার তলব করার পরে তিনি কী ভাবছেন বা কী করতে চলেছেন, সেই বিষয়ে কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। কারণ, তাঁর মোবাইল নীরব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy