Advertisement
E-Paper

ক্যামেরা মোড়া চারতলা বাড়িতে বৈভবের ছাপ! ট্যাংরার দে পরিবারে তিন মৃত্যু এখনও রহস্যঘেরা

পরিবারের ছ’জনের একসঙ্গে আত্মহত্যার চেষ্টা? না কি খুন? তা নিয়ে ধোঁয়াশা এখনও কাটেনি। ট্যাংরা থানায় ইতিমধ্যে খুনের মামলা রুজু হয়েছে। অভিযুক্ত হিসাবে নির্দিষ্ট কারও নামের উল্লেখ নেই।

বুধবার সকালে ট্যাংরায় বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় দুই মহিলা ও এক কিশোরীর দেহ। পরে ইএম বাইপাসে ওই পরিবারেরই আরও তিন সদস্য দুর্ঘটনার কবলে পড়েন।

বুধবার সকালে ট্যাংরায় বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় দুই মহিলা ও এক কিশোরীর দেহ। পরে ইএম বাইপাসে ওই পরিবারেরই আরও তিন সদস্য দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:৫৬
Share
Save

ট্যাংরার অতুল শূর রোড এলাকার ‘চিত্তনিবাস’। দে পরিবারের চারতলা বাড়ি। সামনে ফুট পাঁচেকের রাস্তা। বাড়ির একতলায় গাড়ি পার্ক করার বড় জায়গা। গোটা বাড়ি মুড়ে রাখা প্রচুর সিসি ক্যামেরায়। চারতলা বাড়িটির দিকে এক ঝলক তাকালেই নজরে আসবে প্রতিটি কোনায় বৈভবের ছাপ। বাড়ির বাইরের নকশায় রয়েছে রুচিশীলতার ছোঁয়া। বাড়ির বাইরে একতলার সামনের দিকে অনেকটা অংশ জুড়ে সুদৃশ্য টালি বসানো। এই বাড়ি থেকেই বুধবার সকালে উদ্ধার হয়েছে দুই মহিলা এবং এক কিশোরীর নিথর দেহ। কী ভাবে তাঁদের মৃত্যু, আত্মহত্যা না কি খুন? তা নিয়ে রহস্যের মাঝে বুধবার রাতে ট্যাংরা থানায় খুনের মামলা রুজু হয়েছে। অভিযোগ জানিয়েছেন মৃত এক মহিলার বাবা। অভিযুক্ত হিসাবে নির্দিষ্ট ভাবে কারও নামোল্লেখ নেই।

ট্যাংরার এই বাড়ি থেকে বুধবার সকালে উদ্ধার হয় রোমি দে এবং সুদেষ্ণা দে-র দেহ। পাওয়া যায় রোমির মেয়ে প্রিয়ম্বদার দেহও। কিছু সময় পরে জানা যায়, ইএম বাইপাসে অভিষিক্তা মোড়ের কাছে পথ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন দে পরিবারের আরও তিন সদস্য। আহত হন রোমির স্বামী প্রসূন দে, সুদেষ্ণার স্বামী প্রণয় দে এবং পরিবারের এক নাবালক সদস্য। পরিবারের সকলেই না কি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেই তত্ত্ব কতটা সত্য, তা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। পুলিশের হাতে অনেক তথ্যই এসেছে। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে এখনও তা প্রকাশ্যে আনছেন না তদন্তকারীরা।

সোমবারও পায়েসের সঙ্গে কড়া ডোজ়ের ওষুধ?

একটি সূত্র মারফত এমনও জানা যাচ্ছে, দে পরিবারের সদস্যেরা সোমবার পায়েসের সঙ্গে কড়া ডোজ়ের ওষুধ খেয়েছিলেন। কেন? আত্মহত্যার উদ্দেশে? তা জানা যায়নি। দুর্ঘটনার পরে আহতদের দাবি, আর্থিক সমস্যার কারণেই একসঙ্গে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তাঁরা! এটি অবশ্য মঙ্গলবার রাতের ঘটনার কথা। তাঁদের দাবি, ছ’জন একসঙ্গে পায়েসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খেয়েছিলেন। পরে গাড়ি নিয়ে তিন জন বেরিয়ে পড়েন এবং আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে পিলারে ধাক্কা মারেন। কিশোরী-সহ দুই মহিলার মৃত্যুর সময় নিয়েও ধন্দে পুলিশ। স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, এক দিন আগে থেকেই ওই বাড়ির কাউকে ডাকাডাকি করে সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে মৃত্যুর সময়ের জন্যেও ময়নাতদন্তের রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে তদন্তকারীরা।

দে পরিবারের চামড়ার ব্যবসা রয়েছে। কারখানাও রয়েছে তাদের। সেই কারখানাতেও বৈভব এবং রুচিশীলতার ছাপ স্পষ্ট। আশপাশের লোকেরা বলছেন, মঙ্গলবারও খোলা ছিল কারখানা। বুধবার অবশ্য সেটি বন্ধ পড়ে রয়েছে সকাল থেকে। বাইরে থেকে দেখে বোঝা গেল, চারতলা বাড়ির মতো কারখানাটিও পরিপাটি করে গোছানো। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয় কারখানাটি। এমন বৈভবশালী পরিবারে আর্থিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যার তত্ত্ব কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে অনেকের মনেই।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

রহস্য এবং প্রশ্ন সিসি ফুটেজেও

মঙ্গলবার বেশি রাতের দিকের একটি সিসি ক্যামেরা ফুটেজও প্রকাশ্যে এসেছে। ওই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন। তাতে দেখা যাচ্ছে, রাত ১২টা ৫১মিনিট নাগাদ প্রথমে পরিপাটি করে নীল জামা এবং প্যান্ট পরে এক ভাই বাড়ি থেকে বার হলেন। একতলার গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করা হল। এর পর এক ভাই বাড়ির সদর দরজার সামনে এগিয়ে গেলেন। পর ক্ষণেই গিয়ে বসলেন গাড়িতে। চালকের আসনে। এর পরে বেরিয়ে এল কিশোর। মঙ্গলবার রাতে কলকাতা শহরে শীতের অনুভূতি তেমন ছিল না। তবে ওই কিশোরের পরনে ছিল হুডি। বাড়ির দরজা থেকে বেরিয়ে ঈষৎ টলমল পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে চালকের পাশের আসনে বসল সে। শেষে অপর ভাই বেরিয়ে এলেন। হাত বগলদাবা করে কিছু নিয়ে গাড়ির পিছনের আসনে গিয়ে বসলেন তিনি। এর পর তাঁরা কোথায় গেলেন, তা এখনও অধরা। বুধবার সকালে জানা যায়, গাড়ি দুর্ঘটনার কথা।

শরীরে আঘাতের চিহ্ন কেন?

পুলিশ সূত্রে খবর, ট্যাংরার বাড়িতে মৃত কিশোরীর মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছিল। ঠোঁট এবং নাকের নীচে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। অপর দুই মহিলার হাতের শিরা কাটা ছিল। তবে তাঁদের গলাতেও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা হয়ে থাকলে গলায় আঘাতের চিহ্ন কেন? কিশোরীর ঠোঁট এবং নাকের নীচেই বা কেন আঘাতের চিহ্ন মিলেছে? তা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। পুলিশ সূত্রে খবর, কিশোরের শরীরেও আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। ওই আঘাতই বা কী ভাবে, তা-ও স্পষ্ট নয় এখনও। দুই মহিলা এবং এক সন্তান বাড়িতে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন? বাকি তিন জন বাড়ির বাইরে গিয়ে আত্মহত্যার কথা কেন ভাবলেন? তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে।

তিন ঘরে তিন দেহ! ছুরি অন্য তলায়

সুদেষ্ণা, রোমি এবং রোমির মেয়ে— তিন জনের দেহ পাওয়া গিয়েছে তিনটি পৃথক ঘর থেকে। পুলিশ সূত্রে খবর, চারতলা ওই বাড়ির দোতলায় তিনটি পৃথক ঘরে দুই মহিলা এবং এক কিশোরীর দেহ পাওয়া গিয়েছে। একটি কাগজ কাটার ছুরিও উদ্ধার হয়েছে। সেটি আবার মিলেছে বাড়ির সম্পূর্ণ অন্য একটি তল থেকে। তিন জনের মৃত্যুর আগেই কি দুই ভাই নাবালককে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে? না কি আগেই মৃত্যু হয়েছিল দুই মহিলা ও নাবালিকার? প্রতিবেশীরা কেন এক দিন আগে থেকে ওই বাড়িতে কারও সাড়াশব্দ পাচ্ছিলেন না? সত্যিই কি আত্মহত্যা, না কি খুন? সম্ভাব্য সব দিক খতিয়ে দেখছে পুলিশ। পুলিশের বক্তব্য, পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পরেই উত্তর দেওয়া সম্ভব।

তদন্তে প্রশ্ন অনেক, হবে পুনর্নির্মাণ

তদন্ত যত এগিয়েছে, রহস্য ঘন হয়েছে। ঘুমের ওষুধ খাওয়ার পর কেন তাঁরা গাড়ি নিয়ে বেরোলেন? কেনই বা শিরা কাটা হল দুই মহিলার? তবে কি বাড়িতে তিন জনকে খুন করার পর তাঁরা পালানোর উদ্দেশ্যে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন? পিলারে ধাক্কা কি ইচ্ছাকৃত? না পালানোর পথে নিছক দুর্ঘটনা? অনেক প্রশ্নই উঠে আসছে। পুলিশ ইতিমধ্যে ঘটনার তদন্তে অনেক তথ্য হাতে পেয়েছে। তবে সব প্রকাশ্যে আনছে না। কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা জানিয়েছেন, ট্যাংরার ঘটনার পুনর্নির্মাণ করা হবে। যে হেতু পরিবারের দুই সদস্যই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাই সেই প্রক্রিয়ায় দেরি হচ্ছে। এখনই পুনর্নির্মাণ করা যাচ্ছে না। প্রণয় এবং প্রসূন সুস্থ হলে তাঁদের ঘটনাস্থলে নিয়ে গিয়ে পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করবেন তদন্তকারীরা। সিপি বলেন, ‘‘আরও কিছু তথ্য আমাদের হাতে এসেছে। হাসপাতালে আহতেরা যা বয়ান দিয়েছেন, তা যাচাই করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই আমরা সব তথ্য প্রকাশ করতে পারছি না। কোনও সুইসাইড নোট পাওয়া যায়নি।’’

সংক্ষেপে
  • ১৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৩টের পরে অভিষিক্তা মোড়ের কাছে একটি স্তম্ভে ধাক্কা দিয়েছিল তাঁদের গাড়ি। প্রণয় এবং প্রসূন দাবি করেছিলেন, আত্মহত্যা করার জন্যই ওই পদক্ষেপ করেছিলেন তাঁরা। প্রণয়ের বয়ানও খতিয়ে দেখতে চায় পুলিশ।
  • সোমবার রাতে প্রসূনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁর দাদা প্রণয় দে এবং প্রণয়ের কিশোর পুত্র প্রতীপ এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রতীপ জানিয়েছে, কাকা তাকেও খুন করার চেষ্টা করেছিলেন। মঙ্গলবার প্রসূনকে আদালতে হাজির করানো হয়েছিল। ৬ মার্চ পর্যন্ত তাঁকে পুলিশি হেফাজতে থাকতে বলা হয়েছে।
Mysterious death Tangra Kolkata Police

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}