বাছাই: কাজের ফাঁকেই পছন্দ করে ঘুড়ি কেনা। বৃহস্পতিবার, নাগেরবাজারে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
প্রতি বছর এই সময় রাত জাগত পাড়ার গুটি কয়েক বাড়ি। ন’টার পর থেকে ঘড়ির কাঁটা যত ডান দিকে হেলত দোকানটার সামনে থেকে তত হইচই বেশি করে কানে বাজত পাড়ার চক্রবর্তী, মল্লিক আর বসাক পরিবারের। সেরাটা ঘরে তোলার লড়াই মারামারি পর্যন্ত গড়াত। তবেই না ভো-কাট্টার উল্লাসে ভাসা যাবে! দমদম রোড চত্বরের সেই বিশেষ দোকানটির ঘুড়ি আর সুতো কিনতে দূর থেকে মানুষ সাইকেলে চেপে চলে আসতেন। রাত জাগতেন। রাতভর চা-বিস্কুট বিক্রিও হত ঘুড়ির দৌলতে। এখন সেই দোকানে ঘুড়ি বিক্রি হয় বটে তবে তা নামমাত্র। রাত এগারোটার আগেই ঝাঁপ পড়ে যায়।
ঘুড়ির এই মন্দার কারণের জন্য মোবাইলকে দায়ী করেন বিক্রেতারা। মেটিয়াবুরুজের কাচ্চি সড়কের ঘুড়ি ব্যবসায়ী আফতাব আলমের যত রাগ মুঠোফোনের উপরে। “গত বছরের থেকেও বাজার খারাপ এ বছর। একটা ওইটুকু যন্ত্র কত পেটের ক্ষতি করল। মানুষকে বসিয়ে দিল। আর চিনা মাঞ্জা। দুইয়ের দাপটে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে সবটাই। পরিস্থিতি যা, তাতে অন্য ব্যবসার কথা ভাবতে হবে।”
বৌবাজারের অক্রূর দত্ত লেনের ঘুড়ি ব্যবসায়ী নীলমণি সেনের মতে, বাজার খারাপের তিনটি কারণ। মোবাইল, চিনা মাঞ্জা আর এ বছরের খামখেয়ালি আবহাওয়া। তাঁর কথায়, “লোহার গুঁড়ো মেশানো চিনা মাঞ্জা সরকার নামেই নিষিদ্ধ করেছে। এ বছরও মেটিয়াবুরুজ আর এন্টালির আশি শতাংশ বাজার চিনা মাঞ্জার দখলে। খোলাখুলি বিক্রি হচ্ছে! পুলিশ কোথায় ধরছে?” আক্ষেপের সুরে জানালেন, দামি আতপ চাল, ভাঙা ওয়াইনের বোতল আর বেলজিয়াম কাচের গুঁড়ো মিশিয়ে বরেলীর বিশেষ মাঞ্জায় ঘুড়ি ওড়ানোর আমেজ যে আলাদা তা আর ক’জন বোঝেন!
তবে আশার আলো একটাই, এর মধ্যেও জেগে আছেন শহরের কিছু ঘুড়ি পাগল। যাঁরা আজও বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি আর লাটাই নিয়ে ছাদে ওঠা জীবনের অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করেন। যাঁরা সস্তার চিনা-ফাঁদে পা না দিয়ে ঘুড়ি ‘বুটিকে’ ফরমাশ মতো নকশা করা ঘুড়ি আর বিশেষ মাঞ্জা কেনেন। শ্রীভূমি, শ্যামবাজার, শোভাবাজার, কুমোরটুলি, বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছেন এমন ঘুড়িপাগল। রাজবল্লভ পাড়ার বাসিন্দা ব্যোমকেশ ও হৃষিকেশ ঘোষ তেমনই দু’ভাই। তাঁদের মধ্যে আবার ব্রাজিল উন্মাদনাও প্রবল। ইতিমধ্যেই নীলমণিবাবুর বুটিকে দুই ভাইয়ের বরাত দেওয়া দেড়শোটি ব্রাজিলের পতাকা ঘুড়ি তৈরি হয়ে আছে। নিজেরা ওড়ানোর পাশাপাশি প্রিয়জনদের সেগুলো উপহার দেবেন তাঁরা। এ জন্য হাজার সাতেক খরচ হলেও পরোয়া নেই। ঘুড়ি আর ব্রাজিল দুইয়ের আঁচে পাড়াটা যে পুরো জমজমাট হয়ে উঠবে সেই আশ্বাস দিচ্ছেন ভ্রাতৃদ্বয়। হৃষিকেশের কথায়, “এলাকার প্রতি বাড়ির ছাদে ওই দিন লোক থাকবেনই। এ বারও মাইকে ভো-কাট্টা সংক্রান্ত বাংলা-হিন্দি গান চলবে। বৃষ্টিও আটকাতে পারে না আমাদের।”
ঘুড়ি বিক্রেতাদের মতে, এমন কয়েক জন পাগল খেলার প্রচারে যদি সক্রিয় হতেন তা হলে ম্রিয়মাণ ছবিটা হয়ত বদলাত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy