Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

বই বাঁচানোর যন্ত্রে জং, নির্লিপ্ত জাতীয় গ্রন্থাগার

না লাগানো হচ্ছে কাজে। না দেওয়া হচ্ছে সুস্থ আশ্রয়। অব্যবহৃত অবস্থায় প্যাকেটবন্দি হয়ে পড়ে থাকতে থাকতে মরচে ধরে নষ্ট হচ্ছে পাঁচ বছর আগে কেনা প্রায় ৪০ লক্ষ টাকার যন্ত্রপাতি। এমনই অভিযোগ উঠেছে আলিপুরের জাতীয় গ্রন্থাগারে। সুস্থ থাকার জন্য ওদের দরকার ছিল শুকনো আবহাওয়ার।

মধুরিমা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৫ ০২:৫৯
Share: Save:

না লাগানো হচ্ছে কাজে। না দেওয়া হচ্ছে সুস্থ আশ্রয়। অব্যবহৃত অবস্থায় প্যাকেটবন্দি হয়ে পড়ে থাকতে থাকতে মরচে ধরে নষ্ট হচ্ছে পাঁচ বছর আগে কেনা প্রায় ৪০ লক্ষ টাকার যন্ত্রপাতি। এমনই অভিযোগ উঠেছে আলিপুরের জাতীয় গ্রন্থাগারে।

সুস্থ থাকার জন্য ওদের দরকার ছিল শুকনো আবহাওয়ার। কিন্তু তার বদলে জুটেছে স্যাঁতসেঁতে ঘর। সেই ঘরের এক কোণে পড়ে থেকে ওই সব দামি যন্ত্র নিজেরা তো অকেজো হয়ে যাচ্ছেই। যাদের ভাল রাখার জন্য তাদের আনা হয়েছিল, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেই সব মূল্যবান বইও।

কী কী যন্ত্র পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে?

জাতীয় গ্রন্থাগার সূত্রের খবর, ওই সব যন্ত্রের মধ্যে আছে: l তাপ ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা থেকে বইয়ের পাতাকে রক্ষা করার জন্য কেনা ‘এজিং চেম্বার’। l পোকামাকড় থেকে বই বাঁচানোর জন্য আনা ‘ইনকিউবেটর’। l গ্রন্থাগারের বইয়ের স্তূপের তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতার উপরে নিয়মিত নজরদারির জন্য কেনা ‘ডেটালগার’। l বইয়ের পাতার রং, ঔজ্জ্বল্য বজায় রাখা ও সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ‘ব্রাইটনেস টিজার’ ইত্যাদি।

গ্রন্থাগারের কর্মীদের একাংশের অভিযোগ, কেনার পর থেকে ওই সব যন্ত্রকে প্যাকেট থেকে বার করাই হয়নি। তাই সেগুলি কী ভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেটা সকলেরই অজানা। অথচ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বহু মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য বই নষ্ট হতে বসেছে। তার মধ্যে আছে রাম রাম বসুর ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত’, জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’, শ্রীরামপুর প্রেস থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ বই, বাইবেলের তামিল অনুবাদ ইত্যাদি। পোকায় কেটে ফুটো করে দিয়েছে অনেক বইয়ের পাতা। ঝুরঝুরে হয়ে গিয়েছে অনেক দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি। বাঁধাই নষ্ট হয়ে পাতা হারিয়ে যাচ্ছে অজস্র বইয়ের। পাতার রং বিবর্ণ হতে হতে এমনই অবস্থা যে, পড়া যাচ্ছে না ছাপা অক্ষরগুলোও। এই ধরনের ক্ষয় রুখে ওই সব পুস্তক সংরক্ষণের জন্যই যন্ত্রগুলি আনা হয়েছিল। কিন্তু অনাদরে-অবহেলায় তাদেরও দশা ওই সব বইয়ের মতোই।

জাতীয় গ্রন্থাগারে গিয়ে দেখা গেল, একতলার তিনটি ঘরে স্তূপ হয়ে পড়ে রয়েছে প্যাকেটবন্দি ওই সমস্ত যন্ত্র। কর্মীদের অভিযোগ, ওই সব ঘর সাধারণত তালাবন্ধই থাকে। কোনও ক্রমে একটি ঘর খোলা পাওয়া গেল। ঢুকেই নজরে পড়ল, পেল্লায় দু’টি যন্ত্র গোলাপি প্লাস্টিকে ঢাকা। প্লাস্টিকের চাদর তুলে দেখা গেল, সেগুলি এজিং চেম্বার। মরচে ধরে গিয়েছে। গ্রন্থাগারের কর্মীদের অনেকেরই অভিযোগ, আনার পর থেকে এমন অনেক যন্ত্র এ ভাবেই পড়ে রয়েছে।

ন্যাশনাল লাইব্রেরি স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের তরফে শৈবাল চক্রবর্তী জানান, তিনি তথ্য জানার অধিকার আইনে গত ২৫ মার্চ একটি চিঠি লিখে গ্রন্থাগার-কর্তৃপক্ষের কাছে বই সংরক্ষণে কেনা যন্ত্রপাতির সবিস্তার বৃত্তান্ত জানতে চেয়েছিলেন। কর্তৃপক্ষ জানান, ২০১০ সালে ওই সব যন্ত্র কিনে সে-বছরই বসানো হয় এবং তার সার্টিফিকেট দিয়েছেন তত্কালীন সহ-গ্রন্থাগারিক ও তথ্য আধিকারিক (প্রয়োগশালা) মালবিকা ঘোষ এবং উপ-গ্রন্থাগারিক (বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি) স়ঞ্জয়কুমার মাইতি।

শৈবালবাবু তথ্য জানার অধিকার আইনে আরও একটি চিঠি লিখে যন্ত্রগুলির বছর-ভিত্তিক ব্যবহারের রিপোর্টের প্রতিলিপি চান। ওই সব যন্ত্র ব্যবহারের কোনও আলাদা রেজিস্টার আদৌ রাখা হয় কি না, জানতে চান তা-ও। জবাব আসে, যন্ত্র ব্যবহারের বার্ষিক পরিসংখ্যান বা নিয়মিত রেজিস্টার, কোনওটাই নেই। শৈবালবাবু বলেন, ‘‘পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই সব দামি যন্ত্রপাতি। এক হিসেবে এটা প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে যে, কর্তৃপক্ষের তরফে ভুয়ো ইনস্টলেশন সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল।’’

যন্ত্রগুলি ব্যবহার করা হচ্ছে বলে যিনি শংসাপত্র দিয়েছিলেন, সেই মালবিকাদেবীর কাছে বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘‘আমি সাংবাদিকদের কিছুই জানাব না। তথ্য জানার অধিকার (আরটিআই) অফিসার যা বলার বলবেন।’’

কী বলছেন আরটিআই অফিসার?

আরটিআই অফিসার বলেন, ‘‘আমার কাছে যা তথ্য ছিল, ওই চিঠির উত্তরে সেটাই জানিয়েছি। আমি তো তথ্য বানাতে পারি না।’’

তা হলে যন্ত্র ব্যবহারের রেজিস্টার নেই কেন? ওই অফিসার বলেন, ‘‘তা আমি বলতে পারব না।’’

জাতীয় গ্রন্থাগারের ডিরেক্টর জেনারেল অরুণকুমার চক্রবর্তী সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘সব ঠিক চলছে।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE