প্রশাসনিক সভামঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী। বাঁ দিকে রয়েছেন সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, ডান দিকে হাওড়ার মেয়র রথীন চক্রবর্তী। সোমবার আমতায়। ছবি: সুদীপ আচার্য
প্রথমে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘কুণাল চোর? মদন চোর? মুকুল চোর? আমি চোর?’’ তার কয়েক মাসের মধ্যে তাঁরই নেতৃত্বে কলকাতার রাস্তায় মিছিল হয়েছিল ‘আমরা সবাই চোর’ প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে! বছর ঘুরতে কয়েক দিন আগে তাঁর মন্তব্য ছিল, জেলে যেতে তিনি ভয় পান না! এ বার সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, ব্যক্তিগত ভাবে কেউ দুর্নীতিতে জড়িত হয়ে থাকলে দল দায়ী নয়। দলকে চোর বলা যাবে না!
সারদা-কাণ্ডের তদন্ত যখন যে ভাবে এগোচ্ছে, তখন সেই মতোই অবস্থান বদল করে চলেছেন তৃণমূল নেত্রী। যাঁর নেতৃত্বে গত বছর নভেম্বরে ‘আমরা সবাই চোর’ ডাক দিয়ে মিছিল হয়েছিল, যাঁর নির্দেশে সল্টলেকে সিবিআই দফতরের সামনে শাসক দলের ধর্ণা হয়েছিল, সোমবার তাঁরই মন্তব্যে অবস্থানের ফারাক দলের নেতা-কর্মীদের চোখেও স্পষ্ট! মুখ্যমন্ত্রী মমতার এ দিনের মন্তব্য আশঙ্কাও উস্কে দিয়েছে শাসক দলের অন্দরে। প্রথমে চক্রান্তের তত্ত্ব এনে, কেন্দ্রীয় সরকারকে চ্যালেঞ্জের কথা বলেও এখন সুর বদলে কেন ‘ব্যক্তি’র ঘাড়ে দায় ঠেলে দিয়ে দলকে সরিয়ে নিতে চাইছেন মমতা? শাসক দলেই আরও প্রশ্ন, তা হলে কি তদন্তের ফাঁস আরও চেপে বসছে দেখে ক্রমশ রক্ষণাত্মক হয়ে পড়ছেন তৃণমূল নেত্রী? বিধানসভা ভোটের আগে এমন মন্তব্য করে মদন মিত্রের মতো সারদায় অভিযুক্তদের দায়ই দলের কাঁধ থেকে নামিয়ে ফেলতে চাইলেন কি না, তৃণমূলের মধ্যে জোর জল্পনা তা নিয়েও!
হাওড়ার আমতা স্পোর্টিং মাঠে প্রশাসনিক সভায় মমতা এ দিন বলেছেন, ‘‘আমার কাছে টাকা নেই। আমি খুব কষ্ট করে চলি। আমি চাই, আমার কর্মীরাও কষ্ট করে চলুক। টাকা-পয়সা হাতে থেকে গেলে লোকে বিলাসী হয়ে পড়ে! তা করতে গিয়ে কেউ যদি অসৎ পথ নেয়, তার জন্য দল দায়ী নয়। ব্যক্তিগত চোর হয়। দল চোর হয় না!’’ মমতা অবশ্য সারদা-কাণ্ডের কথা এক বারও উচ্চারণ করেননি। আগের দিন সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীদের সমাবেশে যে ভাবে অসহিষ্ণুতা-বিতর্কের মোড়কে নিজের জেলে যাওয়ার কথা টেনে এনেছিলেন, তেমনই এ দিন বিভিন্ন প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান কমে যাওয়ার অভিযোগ করতে গিয়ে দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলেছেন। কিন্তু তাঁর মন্তব্যে ‘চোর’-অনুষঙ্গের অবতারণা ফের সারদা-কাণ্ডের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে! আর সমাবেশে উপস্থিত তাঁর দলেরই নেতা-কর্মীদের বড় অংশের ধারণা, টাকা-পয়সা পেয়ে ‘বিলাসী’ হয়ে যাওয়ার কথা বলতে দলনেত্রী আসলে প্রাক্তন মন্ত্রী মদনের জীবনযাত্রার দিকেই পরোক্ষে ইঙ্গিত করেছেন!
মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থান বদলকে বিরোধীরা প্রত্যাশিত ভাবেই নিশানা করতে ছাড়ছে না। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র টুইট করেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ব্যক্তি চোরদের জন্য তৃণমূল দল দায়িত্ব নেবে না! উনি কি ভুলে গেলেন ‘আমরা সবাই চোর’ স্লোগান দিয়ে ওঁদেরই সেই মিছিলের কথা?’’ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী আসলে আতঙ্কে দিশাহারা! তাঁর কথায়, ‘‘আপ্রাণ চেষ্টা
করেও যখন তিনি বুঝতে পারলেন সিবিআইয়ের থেকে আর কোনও চোরকেই বাঁচানো সম্ভব নয়, তখন মুখ্যমন্ত্রী এ বার তাঁর নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে অবতীর্ণ হলেন আমতার সভায়!’’
সারদার ভূত ফের শাসক দলকে তাড়া করা শুরু করতেই এ দিন কলকাতায় ফের ‘ভাগ মমতা ভাগ’ স্লোগান ফিরিয়ে এনেছেন বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। দলের ‘উত্থান দিবসে’ শহরে মিছিলের পরে তাঁর দাবি, মদন এখন জেলে। মুকুলও মমতার পাশে নেই। তাই তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী আংশিক সফল! আর মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের মন্তব্যের সূত্রে সিদ্ধার্থনাথের প্রশ্ন, ‘‘এখন সিবিআই মুঠি শক্ত করছে বলে এ সব বলছেন। কিন্তু আমরা জানতে চাই, সারদা-কাণ্ডে জড়িতরা এত দিন আপনার দলে কী করছিল? এত দিন আপনি তাদের বার করে দেননি কেন?’’
প্রশাসনিক সভা থেকেই এ দিন মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘আমার যদি টাকা থাকত, আমি সব উজাড় করে দিতাম! আমার জমি, বাড়ি কোনও কিছুর চাহিদা নেই। কিন্তু আমার টাকা নেই। আমি খুব কষ্ট করে চলি।’’ তাঁর বার্তা, দলের কর্মীরাও একই রকম সরল জীবনযাপনে থাকুন। কিন্তু বাস্তব যে তা নয়, ‘ব্যক্তিগত চোর’দের কথা এনে মমতা নিজেই তা কবুল করে ফেলেছেন— বলছে বিরোধীরা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy