Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
State News

‘তলিয়ে যাওয়ার এই ছবি সারা জীবন আমায় তাড়া করবে’

তেলেনিপাড়ায় বানের তোড়ে অস্থায়ী জেটি ভেঙে তাঁর চোখের সামনেই ঘটে গিয়েছে দুর্ঘটনা। কলম ধরলেন দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কেএমডিএ-র অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার তাপস ঘোষ।ভদ্রেশ্বরে একটা সাইট ভিজিট করার কথা ছিল। চন্দননগরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কাজ সেরে সবে তেলেনিপাড়ার ঘাটে পৌঁছেছি। শ্যামনগর ঘাট হয়ে পরবর্তী গন্তব্য আমার অফিস উন্নয়ন ভবন। মোটরসাইকেল ঘাটের পাশের একটা গ্যারেজে রাখতে রাখতে শুনলাম ভটভটি আপাতত বন্ধ। কারণ, বান আসছে।

বানের তোড়ে এ ভাবেই ভেঙে পড়ল জেটি। —নিজস্ব চিত্র।

বানের তোড়ে এ ভাবেই ভেঙে পড়ল জেটি। —নিজস্ব চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৭ ১৭:৩৯
Share: Save:

ভদ্রেশ্বরে একটা সাইট ভিজিট করার কথা ছিল। চন্দননগরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কাজ সেরে সবে তেলেনিপাড়ার ঘাটে পৌঁছেছি। শ্যামনগর ঘাট হয়ে পরবর্তী গন্তব্য আমার অফিস উন্নয়ন ভবন। মোটরসাইকেল ঘাটের পাশের একটা গ্যারেজে রাখতে রাখতে শুনলাম ভটভটি আপাতত বন্ধ। কারণ, বান আসছে। এমন তো হয়ই। তাই ধৈর্য্য ধরে সবাই প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।

ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা বেজে পাঁচ মিনিট। ঘাটে পৌঁছে দেখলাম প্রায় ১২০-১২৫ জন মানুষ জড়ো হয়েছেন ভটভটির অপেক্ষায়। তাঁদের মধ্যে দুধের শিশু কোলে মা-ও ছিলেন কয়েক জন। এমন প্রায় চার-পাঁচ জন মাকে তো আমিই দেখলাম। বেশ কয়েকটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে তখন খুনসুটিতে মেতে। ভিড়ের মধ্যে নজরে পড়ল বেশ কয়েক জন বয়স্ক মানুষও আছেন। এক জন অশীতিপর ভদ্রলোকের দিকে ঘুরেফিরে নজর চলে যাচ্ছিল আমার। চলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। চোখে মুখেই তা স্পষ্ট। কেন জানি না, দেখেই কেমন মায়া লাগল। ভিড়ের মধ্যে মধ্যবয়স্ক, যুবক ছিলেন অসংখ্য।

আরও পড়ুন

গঙ্গায় ভেঙে পড়ল অস্থায়ী জেটি, তেলেনিপাড়ায় মৃত ৩, নিখোঁজ অনেকে

পনেরো মিনিট অপেক্ষার পর এল সেই বান। প্রায় চার ফুট উঁচু হয়ে ধেয়ে এলো বানের জল। এর পরই হু হু করে জোয়ারের জল ঢুকতে লাগল। জোয়ারের জলে তখন ভাসছে কাঠ বল্লার উপরে দাঁড় করানো পাঁচ ফুট চওড়া সেই বাঁশের জেটি। কোনও রেলিং নেই সেই জেটিতে। তখন তেলেনিপাড়ার ঘাটে কোনও ভটভটি ছিল না। বান সরতেই নজরে পড়ল দূরে শ্যামনগর ঘাট। দু’টি নৌকো সেখানে। তারই একটি লোক ভরে আসছে তেলেনিপাড়ার দিকে। জোয়ারের জল তখন নদীতে। স্রোতের বিরুদ্ধে লোক ভর্তি নৌকো নিয়ে আসতে বেশ বেগ হচ্ছিল। দূর থেকেই তা মালুম করলাম। বহু ক্ষণের চেষ্টায় তেলেনিপাড়ার বাঁশের জেটির কাছে পৌঁছল সেই নৌকো।

ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন পুলিশকর্মীরা। —নিজস্ব চিত্র।

আমারও টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জেটিতে এত ভিড়! অফিসে পৌঁছনোর একটা তাড়াও ছিল বটে। তবু মনে হল এর পরেরটাতেই না হয় গেলাম। এই গরমে গাদাগাদি করে যাওয়ার কোনও মানে নেই। এই ভেবেই জেটিতে আর যাওয়া হল না।

এ দিকে ভটভটি এসে জেটিতে আটকাতেই তর তর করে নেমে আসতে শুরু করলেন যাত্রীরা। সংখ্যাটা সবে বারো কি তেরো হয়েছে। হুড়মুড়িয়ে চোখের সামনে ধসে গেল জেটি। জেটির উপর দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য মানুষ নিয়ে চোখের নিমেষে তলিয়ে গেল জেটি। তলিয়ে যাওয়া কাকে বলে নিজের চোখে দেখলাম। মায়ামাখা সেই বৃদ্ধকেও দেখলাম ডুবে যেতে। শিশু কোলে মা, আরও আরও অনেকে। আস্তে আস্তে শরীরটা কেমন অবশ লাগতে শুরু করল। মাথাটা কেমন নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। কেবল মনে হল, আমি কি ভাবে রইলাম! আমারও তো এত ক্ষণে ওই অবস্থাই হত। একটু ধাতস্থ হতেই পাশের এক জন ভদ্রলোকের সঙ্গে ১০০ ডায়ালে ফোন করার চেষ্টা করতে লাগলাম। ভদ্রেশ্বর পুরসভার এক জন ইঞ্জিনিয়রাকে ফোনে বিস্তারিত জানালাম। তিনিই জানালেন থানায়। পনেরো মিনিটের মধ্যে পুলিশ চলে এল। শ্যামনগর ঘাট থেকে লোক নিয়ে আসা সেই নৌকাটাও সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকাজে নেমে পড়ল। স্থানীয় নৌকাগুলিও হাত লাগাল সেই কাজে। জানি না কত জনকে বাঁচানো সম্ভব হবে। তবে চোখের সামনে এত মানুষকে তলিয়ে যাওয়ার ভয়াবহ এই ছবি বাকি জীবনটায় তাড়া করবে।

অনুলিখন: জয়তী রাহা।

অন্য বিষয়গুলি:

Accident Death Telenipara
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE