—প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের নিয়োগ তদন্ত ঘিরে এখনও তপ্ত রাজ্য রাজনীতি। গ্রেফতার হয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী, বিধায়ক, যুব নেতা থেকে শুরু করে শিক্ষা দফতরের কর্তাব্যক্তিরা। এর মধ্যেই আরও এক নিয়োগ ‘দুর্নীতি’ ধরা পড়ল রাজ্যের অন্য এক শিক্ষা দফতরে। এ বার মাদ্রাসায়। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, কয়েকশো জনকে নিয়োগপত্র দিয়ে দেওয়া হয়েছিল জাল নথিপত্রের ভিত্তিতে। তবে কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি বা সিবিআই নয়, রাজ্যের পুলিশও নয়, এই বেনিয়ম ধরা পড়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের অভ্যন্তরীণ তদন্তেই। এবং এই তদন্ত, অনুসন্ধানে বড় ভূমিকা পালন করছে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি।
মাদ্রাসা শিক্ষা দফতর সূত্রে খবর, এখনও পর্যন্ত রাজ্যের বিভিন্ন মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য দেওয়া মোট ৫৪৭টি অবৈধ নিয়োগপত্র ধরা পড়েছে। আরও তদন্ত চলেছে। ডিরেক্টর অফ মাদ্রাসা এডুকেশন আবিদ হুসেনকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এর সত্যতা স্বীকার করেছেন। একই সঙ্গে জানিয়েছেন, এমন আরও বেশ কিছু অবৈধ নিয়োগপত্র ধরা পড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। আবিদ বলেন, ‘‘যেটুকু ধরা পড়েছে, তার ফলে রাজ্য সরকারের বহু কোটি টাকার ক্ষতি আটকানো সম্ভব হয়েছে। এই সব জাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে যদি চাকরি হয়ে যেত, তা হলে রাজ্যকে এখনই প্রায় ৪০০ কোটি টাকার দায় নিতে হত।’’
প্রাথমিক তদন্তের পর মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের ধারণা, নথি জাল করে, পুরনো তারিখ দেখিয়ে অন্তত ৯০০ জনকে এমন নিয়োগপত্র দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। কী ভাবে নজরে এল এই বেনিয়ম? সূত্রের খবর, কয়েক বছর ধরে পড়িয়ে বা অশিক্ষক কর্মী হিসেবে কাজ করে ঠিক মতো বেতন পাননি, এমন দাবি তুলে ৯০০-র মতো আবেদনপত্র আসে দফতরে। আবেদনপত্রের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় ‘নিয়োগপত্র’ও। এ নিয়ে সন্দেহ হওয়াতেই শুরু হয় তদন্ত। ক্রমশ সন্দেহ দৃঢ় হয়, এই দাবির পিছনে কোনও দুর্নীতি চক্র কাজ করছে। ওই ৯০০ জনের মধ্যে ৫৪৭টি নিয়োগপত্র ইতিমধ্যেই খতিয়ে দেখেছে সুপ্রিম কোর্টের তৈরি করে দেওয়া বিশেষজ্ঞ কমিটি। এবং ৫৪৭টি নিয়োগপত্রই অবৈধ প্রমাণিত হয়েছে বলে সূত্রের খবর। কিছু দিনের মধ্যেই এই বিষয়ে সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক রিপোর্ট জমা পড়বে। এই চক্রের সঙ্গে বিভিন্ন মাদ্রাসা ম্যানেজিং কমিটির প্রভাবশালীরাও কেউ কেউ জড়িত বলেও সন্দেহ। আবিদ বলেন, ‘‘এই সব জাল নিয়োগপত্র মান্যতা পেয়ে গেলে, সরকারকে বকেয়া বেতন বাবদ ৪০০ কোটি টাকা তো দিতে হতই, সঙ্গে বাড়তি আরও ৩০ কোটি টাকা করে বেতন হিসেবে খরচ হত প্রতি বছর।’’
ঘটনার শুরু ২০০৮ সালে। বামফ্রন্ট আমলে। ওই বছর ‘মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন’ তৈরি করেছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। এর ফলে রাজ্য স্কুল সার্ভিস কমিশনের হাত থেকে সরিয়ে সরকারি এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সমস্ত মাদ্রাসার নিয়োগের দায়িত্ব চলে যায় ‘মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন’-এর হাতে। এই পরিবর্তনে সিলমোহর দিতে, মাদ্রাসার বিভিন্ন পদে চাকরি, বদলি ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ের জন্য ‘মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন অ্যাক্ট’ তৈরি হয় ২০১০ সালে। ২০১৩ সালে কাঁথির একটি মাদ্রাসার পরিচালন কমিটির এক সদস্য কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করে বলেন, ‘মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন অ্যাক্ট’ সংবিধান বিরোধী। তাঁর যুক্তি ছিল, সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক আধিকার আছে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে নিজেদের পছন্দ মতো নিয়োগ করার, রাজ্য সরকার সেখানে নাক গলাতে পারে না। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে, কলকাতা হাই কোর্ট সেই যুক্তি মেনে নেয় এবং ‘মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন অ্যাক্টকে’ সংবিধান বিরোধী বলে রায় দেয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে যায় মাদ্রাসা শিক্ষা দফতর। তারা আদালতে বলে, রাজ্য সরকার যেহেতু শিক্ষকদের বেতন থেকে শুরু করে মাদ্রাসার যাবতীয় খরচ বহন করে, তাই শিক্ষক এবং মাদ্রাসার অন্যান্য সমস্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে নিযুক্তদের মান, নিযুক্তির পদ্ধতি যথাযথ এবং স্বচ্ছ কি না, তা দেখার অধিকার সরকারের থাকা উচিত। তা ছাড়া, যদি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনও রকম মানের ঘাটতি থেকে যায়, তা পড়ুয়াদেরই ক্ষতি করবে এবং মাদ্রাসা শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ই বহাল রেখে বলে, সংবিধান নাগরিকদের জন্য যে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে ‘মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন অ্যাক্ট’ তার বিরোধী। একই সঙ্গে অবশ্য ডিভিশন বেঞ্চ বলে, এই আইন সংবিধান বিরোধী হলেও, শিক্ষকদের মান নিয়ন্ত্রণে সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা দরকার, যাতে মাদ্রাসা শিক্ষার মান যথাযথ থাকে। তাই সরকারের একটা নিয়ন্ত্রণ সেখানে থাকা উচিত। রাজ্য সরকার যদি দেখে, নিয়োগের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম-বিধি মানা হয়নি, সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের অধিকার থাকবে সেই প্রতিষ্ঠানকে যে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয় তা বন্ধ করে দেওয়ার। নিয়োগ যথাযথ না হলে সেই অশিক্ষক কর্মী বা শিক্ষকের মাইনে রাজ্য সরকার বন্ধ করতে পারবে।
২০১৫-র ডিসেম্বরের এই রায়ের আগে, ২০১৪ সালে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন একটি শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা নিয়েছিল। ৩,২০০ জনের একটি প্যানেলও তৈরি হয়েছিল। ইতিমধ্যে মামলাটি শীর্ষ আদালতে যায়। সুপ্রিম কোর্ট বলে, ওই প্যানেল বৈধ। ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে ২০২০-র ৬ জানুয়ারি, যত দিন শীর্ষ আদালতের নির্দিষ্ট নির্দেশ আসেনি, তত দিন অর্থাৎ ওই ৫ বছরের মধ্যে কমিশন যে সব পরীক্ষা নিয়েছে, যত নিয়োগ হয়েছে, সেগুলি বৈধ। কিন্তু ২০২০-র ৬ ডিসেম্বরের পর যদি কোনও নিয়োগ করা হয়ে থাকে তা অবৈধ বলে গণ্য হবে।
এই সময়ই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে পাশ কাটাতে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় মাদ্রাসাগুলিতে অন্তত কয়েকশো জনকে ব্যাকডেটে নিয়োগ করা হয়েছে বলে রাজ্য সরকারের অভিযোগ। যদিও নিয়োগকর্তাদের বক্তব্য, তাঁরা সব নিয়ম মেনেই কাজ করেছেন। রাজ্য সরকারের বক্তব্য, নিয়োগের ক্ষেত্রে বহু ধরনের বেনিয়ম হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের জন্য দরখাস্ত চেয়ে অন্তত দুটি প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিতে হবে, সেই নিয়ম মানা হয়নি। চেনা-পরিচিত এবং আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে থেকে বেশ কিছু নিয়োগ করা হয়েছে বলেও রাজ্য সরকারের অভিযোগ। কিছু ক্ষেত্রে নিয়োগপত্রের সইও জাল বলে ধরা পড়েছে বলে জানানো হয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা দফতর সূত্রে। মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির একাধিক সচিবের জাল সই ব্যবহার করে নিয়োগপত্র দেওয়ার জন্য দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ এবং দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় মাদ্রাসা শিক্ষা দফতর বেশ কয়েকটি এফআইআর-ও করেছে বলে জানিয়েছেন রাজ্যের ডিরেক্টর অফ মাদ্রাসা এডুকেশন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর থানার এমন তিনটি ঘটনা নিয়ে ২০২২ সালে সিআইডি তদন্তও শুরু হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy