গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন। গ্রাফিক সহায়তা: এআই।
পক্বকেশদের সরিয়ে দলীয় কাঠামোয় তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করার সাংগঠনিক প্রক্রিয়া কি ‘যান্ত্রিক’ হয়ে যাচ্ছে? বাংলায় সিপিএমের এরিয়া স্তরের সম্মেলন শেষ করে যখন বেশ কয়েকটি জেলা সম্মেলনও সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে, তখন দলের মধ্যেই এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। শুধু প্রবীণেরা নন, সদ্য ৪০ পার করা দলের অনেক পরিচিত নেতাও একান্ত আলোচনায় বলছেন, বয়সবিধি কার্যকর করতে গিয়ে অনেক ‘পরিণত’ নেতাকে বাদ দিতে হচ্ছে। তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন যে তরুণেরা, তাঁদের অনেকেরই নিচুতলার রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই।
সরকারে থাকার পর্বে দীর্ঘ দিন ধরে সিপিএমের সাংগঠনিক কাঠামোর উপর দিকে তরুণদের অন্তর্ভুক্তি থমকে ছিল। বিচ্ছিন্ন ভাবে তা হলেও সার্বিক কোনও পরিকল্পনা ছিল না। সেই কারণেই যে বঙ্গ সিপিএমে ‘জেনারেশন গ্যাপ’ (প্রজন্মের ফাঁক) তৈরি হয়েছে, তা-ও মানেন প্রথম সারির নেতাদের অনেকে। তিন বছর আগে যখন সিপিএমের সাংগঠনিক প্রক্রিয়া হয়েছিল, তখনও এই বিধিতে অনেক নতুন মুখকে বিভিন্ন স্তরের কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ফলিত স্তরে তাতে কী লাভ হয়েছে? সেই প্রশ্নও উঠছে এ সম্মেলন পর্বে।
যদিও রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের দাবি, ‘‘আগের বার সম্মেলনের সময়ে কিছু আলোচনা থাকলেও এ বার অনেকেই মনে করছেন বয়সবিধি নির্ধারিত করে লাভই হয়েছে।’’ তবে পাশাপাশিই সেলিম মেনে নিয়েছেন, এরিয়া কমিটি স্তরে অনেক জায়গায় বয়সজনিত সংরক্ষিত জায়গা ফাঁকা থাকছে। সিপিএম ঠিক করেছে, প্রতিটি এরিয়া কমিটিতে এক জন করে অনূর্ধ্ব ৩১ বছর বয়সি তরুণকে ঠাঁই দিতেই হবে। আবার কমিটির সদস্যসংখ্যার নিরিখে কত জন ৪০ বছরের মধ্যে এবং কত জন ৫০ বছর বয়সের মধ্যে নেতৃত্ব কমিটিতে থাকবেন, তা-ও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। অনেক জায়গায় এমনও দেখা যাচ্ছে যে, অনূর্ধ্ব ৩১ বা মহিলা সংরক্ষিত জায়গা ফাঁকা থাকছে। সেলিমের দাবি, ‘‘এর ফলে সাংগঠনিক ত্রুটি প্রকাশ্যে আসছে। বোঝা যাচ্ছে, সেই অংশকে পার্টিতে আনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকার নেতৃত্বের ত্রুটি রয়েছে। ফলে তা সংশোধন করতে সুবিধা হবে।’’ সেলিমেরা মনে করেন, স্বল্পমেয়াদে না হলেও এই সংস্কার দীর্ঘমেয়াদে দলের উপকারই করবে।
কিন্তু উল্টো প্রশ্নও উঠছে। দলের অনেকের বক্তব্য, যে তরুণদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে ‘নেতা’ করা হচ্ছে, তাঁরা অনেকেই দলের ‘বনিয়াদি’ কাজ করেন না। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘তরুণদের সকলেই সমান নন। তবে একটি বড় অংশ রয়েছেন, যাঁরা মূলত পার্টি অফিসের আড্ডা, ফেসবুক আর তাঁদের ঘিরে থাকা লোকজনকেই গোটা দুনিয়া ভেবে নিচ্ছেন। তাঁদের নিয়েই মৌলিক কিছু সমস্যা রয়েছে। আবার অনেকেই আছেন, প্রচারের আড়ালে থেকে নতুন ক্ষেত্রের ট্রেড ইউনিয়নে কাজ করছেন। তাই শুধু বয়সকে মাপকাঠি না করে সাংগঠনিক দক্ষতা এবং বয়সকে একসঙ্গে ফেলে যোগ্যতা নির্ণয় করা উচিত।’’ তবে দলের অনেকের বক্তব্য, ক্ষমতায় থাকার সময়ে এই বিধি কার্যকর হলে প্রজন্ম বিচ্ছিন্নতার এই জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে হত না।
সিপিএমের অনেকের এ-ও বক্তব্য, বহু জায়গায় এমন তরুণেরা দায়িত্ব পাচ্ছেন, যাঁদের ‘উদ্যম’ থাকলেও ‘রাজনৈতিক বোধ’ কম। সেটাও সংগঠনে সমস্যার কারণ। তরুণদের নেতা করে তার পর শেখানো উচিত? না কি শিখিয়ে নেতা করা উচিত, আপাতত এটাই এখন সিপিএমের কাছে ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’র মতো জবাবহীন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিপিএমের অন্দরমহল যে প্রশ্নে সরব, তার মুখোমুখি আগেই হয়েছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল। যেমন তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, বয়সটা কোনও সূচক নয়। মনের বয়সই আসল। যে কারণে তিনি গত লোকসভা ভোটেও সৌগত রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়দের টিকিট দিয়েছিলেন। আবার তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্টই বলেন, সব পেশার মতো রাজনীতিতেও অবসরের বয়স নির্দিষ্ট থাকা উচিত এবং তা কখনওই ৬৫ বছরের বেশি হওয়া উচিত নয়। যদিও সংগঠনে সেই বিধি তিনি এখনও পর্যন্ত কার্যকর করতে পারেননি।
একটা সময়ে অভিষেকের নবীন-তত্ত্বের আগ্রাসী সমর্থক ছিলেন কুণাল ঘোষ। সিপিএমে সাম্প্রতিক বিতর্ক সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, ‘‘মমতাদি দলে পাঁচটি প্রজন্ম তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁরা সময়ের নিয়মেই দায়িত্ব পাচ্ছেন। আমাদের দলে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা কমবয়সি অথচ একাধিক বারের জনপ্রতিনিধি। আবার সেই বয়সি সিপিএমের কেউ কেউ ভোটে হারের হ্যাটট্রিক করে ফেলেছেন। তফাতটা এখানেই।’’ তৃণমূলের ‘প্রবীণ’ সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নিজস্ব তত্ত্ব আউড়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বয়স কখনও রাজনীতিতে সূচক হতে পারে না। শারীরিক এবং মানসিক উদ্যম, সেই সঙ্গে তিনি কী কাজ করছেন, সেটাই নিরিখ হওয়া উচিত।’’ কল্যাণের এ-ও পর্যবেক্ষণ, ‘‘সিপিএমের এখনও যাঁরা নিচুতলায় নিবিড় যোগাযোগ রেখে চলেন, তাঁরা সকলেই প্রবীণ। নবীনদের বেশির ভাগই ফেসবুকে সক্রিয়। মাঠে-ময়দানে নয়।’’
সাংগঠনিক স্তরে পরীক্ষানিরীক্ষা করেও সিপিএম ভোটের বাক্সে বিশেষ দাগ কাটতে পারেনি। ঘটনাচক্রে, গত লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম একগুচ্ছ তরুণ মুখকে প্রার্থী করেছিল। কিন্তু দেখা গিয়েছে, কাস্তে-হাতুড়ি-তারার জামানত রাখতে পেরেছেন দুই প্রবীণ— মুর্শিদাবাদে সেলিম এবং দমদমে সুজন চক্রবর্তী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy