Advertisement
০৯ জানুয়ারি ২০২৫
Online Classes

করোনা গেলেও টিকে গেল অনলাইন শিক্ষা! বাড়িতেই ক্লাসঘর বানানোর কারণ কী? উত্তর দিলেন শিক্ষকেরা

করোনা দু’বছরে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক কাছের মানুষ, অনেক স্বপ্ন। কিন্তু এর একমাত্র ভাল দিক বোধ হয় প্রযুক্তি। কোভিডকালে যার সঙ্গে ছোট থেকে বড় সকলের সম্পর্ক গাঢ় হয়েছে।

ছবি: সংগৃহীত।

নবনীতা গুহ
শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:০৭
Share: Save:

শুরুটা হয়েছিল কোভিড-কালে। একটা দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে চলছে যখন গোটা পৃথিবী। মুখোমুখি দেখা হওয়ার যখন উপায় নেই, ঠিক তখনই মোবাইল, ট্যাব বা ল্যাপটপের স্ক্রিনই হয়ে উঠেছিল একমাত্র সম্বল। ‘অনলাইনে’ যোগাযোগ, কাজকর্মের বিষয়টা অবশ্য নতুন ছিল না। তবে প্রযুক্তি এই কোভিডকালে পৌঁছে গিয়েছিল আমাদের ঘরের কোনায় কোনায়। স্কুল, কলেজ, অফিস এমনকি, টাকা-পয়সার আদানপ্রদানও চলছিল ঘরে বসেই, অনলাইনে। ছোট থেকে বড়, প্রযুক্তির ধারকাছেও যাঁরা ঘেঁষতে চাইতেন না, সবটা শিখে নিচ্ছিলেন সকলে।

তবে শুধু স্কুলের গণ্ডিতে আটকে না থেকে এই অনলাইনের সুবিধা পৌঁছে গিয়েছিল গান-নাচ, কবিতা, ছবি আঁকা এমনকি টিউশনের ক্ষেত্রেও। তার পরে কেটে গিয়েছে চার বছর। আর এই সময়ের মধ্যে তাতেই যেন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন শিক্ষক থেকে শিক্ষার্থী, সকলে। সামনে থেকে বা অফলাইন ক্লাস করার সুযোগ-সুবিধা তো আছেই আগের মতো, কিন্তু সঙ্গে যে কোনও প্রয়োজনে করা যাচ্ছে অনলাইন ক্লাসও। কোনও কিছু শিখতে চাই অথচ তার ক্লাস হয়তো আমার শহরে বা বাড়ির কাছে নেই, বা হয়তো আমার পছন্দের শিক্ষক আর আমি রয়েছি শহরের দুই প্রান্তে বা দুটো ভিন্ন শহরে বা দেশে, সে ক্ষেত্রেও সমাধান সেই অনলাইন ক্লাস। এই অভ্যাস যদিও নতুন নয়, কিন্তু কোভিড-কালের পরে ভাল শিক্ষক পেতেই হোক বা অমূল্য সময় বাঁচাতে, অনলাইন ক্লাসে এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের শিক্ষকদের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সি ছাত্র-ছাত্রী।

বেহালা থেকে বার্মিংহাম কবিতা শেখান সাম্য কার্ফা। বললেন, “কোভিডের সময়ে মঞ্চে অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফেসবুক লাইভে শুরু হল অনুষ্ঠান করা। তবে তা তো আয়ের ঠিকঠাক উৎস হতে পারে না। ঠিক মতো দেখানো, শোনানো সম্ভব হচ্ছিল না। এর পরে এল ডিজিটাল কনসার্টের ভাবনা। ঠিকঠাক জায়গায় শ্যুট করা হত, শিল্পীরা বাড়িতেও নানা রকম উপকরণ কিনে নিলাম। অনেক কিছু নতুন করে শিখতে হল। ডিজিটাল কনসার্ট এখন কমে গিয়েছে অবশ্য। তবে এখনও কলকাতার অনেক অনুষ্ঠান মঞ্চে হলেও তা রেকর্ড করা হয়, তার পরে সপ্তাহখানেক পরে তা ডিজিটাল ভাবে প্রকাশ করা হয় টিকিট কেটে দেখার জন্য। এর ফলে আগে যদি একশো জন কোনও অনুষ্ঠান দেখতেন, এখন তা দেখার সুযোগ রয়েছে গোটা পৃথিবীর।”

জানালেন, কোভিডের আগে থেকেই তো অনলাইন ক্লাস হয়। তবে তা মূলত করতেন দেশের বাইরের ভারতীয়রা। করোনার সময় সল্টলেক, উত্তর কলকাতার বাসিন্দারাও সহজেই দক্ষিণ কলকাতায় তাঁর কাছে ক্লাস করছেন সেই অনলাইনের মাধ্যমে। যা চলছে এখনও। সাম্য বললেন, ‘‘পাশাপাশি বসে বা সামনে থেকে ক্লাস করার গুরুত্ব রয়েছে অবশ্যই তবে, ছোটদের ক্ষেত্রে বলা যায়, অনলাইন ক্লাস করলে যাতায়াতের অনেকটা সময় বেঁচে যায়। সেখানে সে পড়াশোনা করতে পারছে। বড়রাও অনেকেই ছোট বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর পরে, কেউ বা বাড়ির কাজ সেরে বা অফিসের কাজের পরে ক্লাস করতে পারছেন, নিজের শখ পূরণ করতে পারছে। এতদিন যা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে উঠছিল না।”

অনলাইন শিক্ষা গানের ক্ষেত্রেও নতুন নয়, জানালেন সঙ্গীত শিক্ষিকা মধুজা মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “বিদেশে থাকা মূলত ভারতীয়রা অনেকেই ভারতীয় সঙ্গীত অনেক আগে থেকেই শিখতেন অনলাইন মাধ্যমে, ভারতীয় সঙ্গীত শিক্ষকদের কাছ থেকে। তবে করোনার পর থেকে এই চর্চা বেড়েছে দেশের ভিতরে এমনকি এক শহরের মধ্যেও। আধুনিক যন্ত্র, ওয়াইফাই-এর ব্যবহারও বেড়েছে। এতে শিক্ষা স্থান, কাল, পাত্র নির্বিশেষে ছড়িয়ে পড়ছে। দূরত্বের কারণ যাতে শিক্ষায় বাধা না হয়ে দাঁড়ায়, তা কিন্তু নিশ্চিত হয়েছে এই অনলাইন ব্যবস্থায়।” তিনি আরও বলেন, “আগে গুরুগৃহে থেকেই গান শেখা হত। তাতে গুরুর চলন-বলন, ওঠা-বসা সবটাই দেখার ও শেখার ছিল। কিন্তু এখন গুরুগৃহে থেকে শিক্ষা গুরু বা শিষ্য কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। যুগের সঙ্গে সবটাই বদলেছে। তাই করোনাকালে অনলাইন শিক্ষার অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়েছে উভয় পক্ষকেই। সামনে থেকে শেখার ক্ষেত্রে গান নিয়ে যতটা আলাপ-আলোচনা হতে পারে, গুরু-শিষ্যের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, সেটাও ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে অনলাইনে।”

ছবি: সংগৃহীত।

করোনা-কালে আঁকা শেখাতে নতুন করে সব শিখতে হয়েছিল বলে জানালেন শিক্ষিকা স্বাগতা ঘোষ চক্রবর্তী। বললেন, “বাচ্চারা ঘরবন্দি হয়ে পড়েছিল ওই সময়ে, তাই অভিভাবকেরা অনলাইন ক্লাসই বেছে নিয়েছিলেন আঁকা শিখতেও। প্রথমটায় ছাত্রছাত্রীদের মতো আমারও খানিক অসুবিধাই হয়েছিল। এক তো ক্যামেরার সামনে সবটা দেখানো, তার উপর কী ভাবে দাগ টানতে হবে বা কী ভাবে রং করতে হবে, সে সব অনলাইনে বোঝানো, সত্যিই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে ধীরে ধীরে এটাই অভ্যাস হয়ে উঠেছে।” জানালেন, প্রয়োজনের তাগিদে, সময় বাঁচাতে অনেকেই এখন অনলাইন ক্লাস বেছে নিচ্ছেন, তবে সামনে থেকে আঁকা বিষয়টি যে ভাবে বোঝানো সম্ভব, অনলাইনে সেটা খানিক অমিলই।

একটি অনলাইন শিক্ষক সংস্থার কর্ণধার বৃন্দা বসু (রায়) জানালেন, অনলাইনে টিউশন পড়া এবং পড়ানোও অনেক গুণ বেড়েছে কোভিডের পর থেকে, আগে যা অনেকেই ভাবতে পারতেন না। বললেন, “অনলাইন টিউশন সবচেয়ে বেশি উপযোগী হয়েছে সেই সমস্ত বাবা-মায়েদের জন্য, যাঁদের দু’জনকেই কাজের সূত্রে সকাল থেকে সন্ধ্যা বাড়ির বাইরে অফিসে কাটাতে হয়।” তিনি আরও বলেন, “অনলাইন ক্লাসে পড়ুয়াদের যাতায়াতের সময় যেমন বাঁচছে, আবার আমার থেকে অনেকটা দূরত্বে রয়েছেন, এমন কোনও ভাল শিক্ষকের কাছেও পড়তে পারা যাচ্ছে। তেমনিই শিক্ষকদেরও যাতায়াতের সময় বাঁচছে, তাঁরাও বাড়ি বসে পর পর ক্লাস নিতে পারছেন। এ ছাড়া, মেয়েদের ক্ষেত্রে ভালো শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই বিয়ে বা সন্তান হওয়ার পরে নানা কারণে কাজ ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু অনলাইন মাধ্যমে সেই সমস্যা কম হয়। নিজের কাজও যেমন বজায় থাকে, সঙ্গে সংসারে বা সন্তানকে সময় দেওয়াটাও সহজ হয়।”

বৃন্দা জানালেন, বিদেশে থাকা ভারতীয়দের মধ্যে অনলাইনে টিউশন পড়ার বিষয়টি ছিল আগে থেকেই। বললেন, “পাউন্ড, ডলার বা ইউরোর থেকে ভারতীয় টাকায় টিউশন পড়ালে খরচ কম হয়। তাই অনেক ভারতীয়, যারা বিদেশে আছেন, তাঁরা ভারতের শিক্ষকদের বেছে নেন। আর এর আরও একটি সুবিধা হল, যদি দেশে কেউ ফিরে আসেন কখনও, এ দেশের পাঠ্যক্রম নিয়েও তাঁরা ভরসা রাখতে পারেন সেই শিক্ষকের উপরে।”

অনলাইন ক্লাস সুবিধের হয়েছে অনেক অভিভাবকদের কাছেও। সল্টলেকের বাসিন্দা সুচেতনা রায় বললেন, “উত্তর কলকাতায় এক শিক্ষকের কাছে ইংরেজি পড়তে নিয়ে যেতাম। তবে চিন্তায় ছিলাম ছেলের উঁচু ক্লাস হলে কী করে সময় দেবে যাতায়াতে, করোনার পরে অনলাইন ক্লাস শুরু হওয়ায় সময় বাঁচছে অনেক। ঘরে বসেই পছন্দের শিক্ষকের কাছে পড়া যাচ্ছে।” অনলাইনে কবিতা শেখে ক্লাস এইটের অনুষ্কা সরকার। তার বক্তব্য, “অনলাইন ক্লাস হওয়ায় আলাদা করে এই ক্লাসের জন্য বেরোতে হয় না। সময় বাঁচে, ঘরে বসে ভাল করে শেখাও যায়।”

করোনা দু’বছরে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক কাছের মানুষ, অনেক স্বপ্ন, অনেক কিছু। কিন্তু এর একমাত্র ভাল দিক বোধ হয় প্রযুক্তি। যা অবশ্য আগেও ছিল, কিন্তু এই কোভিড-কালে তার সঙ্গে ছোট থেকে বড় সকলের সম্পর্ক গাঢ় হয়েছে, সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের সঙ্গে প্রযুক্তির বন্ধুত্ব নিবিড় হয়েছে। যা আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছে মুশকিল আসান।

অন্য বিষয়গুলি:

Online Classes School students
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy