Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মুখ ঢেকেছে বহুতল আবাসনে, চন্দননগর হারাচ্ছে তার সবুজ

কড়ি-বরগা, বড় বড় থামযুক্ত তিন-চার মহলা বাড়িগুলি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। মাথা তুলছে নানা রঙের আবাসন। উত্তর থেকে দক্ষিণ, গঙ্গার ধার থেকে স্টেশনের পাশ চন্দননগর জুড়ে এখন ফ্ল্যাট-সংস্কৃতির রমরমা। শহর ঢাকছে আবাসনের বিজ্ঞাপনে। পাকাপাকি ভাবে থাকার জন্য সেই সব আবাসনে ভিড় বাড়ছে কলকাতা, বর্ধমান, শ্রীরামপুর থেকে শুরু করে দিল্লি, মুম্বইয়ের বাসিন্দাদেরও। সকলেরই এক রা শহরের শান্ত, নিরাপদ এবং সুন্দর পরিবেশে তাঁরা মুগ্ধ। তবে, প্রবীণ নাগরিকদের আশঙ্কা, যে ভাবে কংক্রিটের জঙ্গল বাড়ছে, তাতে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৪ ০১:৪৮
Share: Save:

কড়ি-বরগা, বড় বড় থামযুক্ত তিন-চার মহলা বাড়িগুলি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। মাথা তুলছে নানা রঙের আবাসন।

উত্তর থেকে দক্ষিণ, গঙ্গার ধার থেকে স্টেশনের পাশ চন্দননগর জুড়ে এখন ফ্ল্যাট-সংস্কৃতির রমরমা। শহর ঢাকছে আবাসনের বিজ্ঞাপনে। পাকাপাকি ভাবে থাকার জন্য সেই সব আবাসনে ভিড় বাড়ছে কলকাতা, বর্ধমান, শ্রীরামপুর থেকে শুরু করে দিল্লি, মুম্বইয়ের বাসিন্দাদেরও। সকলেরই এক রা শহরের শান্ত, নিরাপদ এবং সুন্দর পরিবেশে তাঁরা মুগ্ধ। তবে, প্রবীণ নাগরিকদের আশঙ্কা, যে ভাবে কংক্রিটের জঙ্গল বাড়ছে, তাতে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে।

বছর পাঁচেক আগে চন্দননগরে জি টি রোডের ধারের জমির দাম ছিল কাঠাপ্রতি ১৫-২০ লক্ষ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫-৩০ লক্ষ টাকায়। একই ভাবে বাড়ছে ওই তল্লাটের ফ্ল্যাটের দামও। বছর পাঁচেক আগে যে ফ্ল্যাটের দাম আড়াই-তিন হাজার টাকা বর্গফুট ছিল, এখন তা কিনতে বর্গফুটপ্রতি গুনতে হচ্ছে তিন-চার হাজার টাকা। এলাকা ভিত্তিতে কোথাও কোথাও দাম আরও চড়ছে। একে তো জিটি রোডের ধারে থাকলে বাজার-দোকান এবং যানবাহনের সুবিধা মেলে, তার উপরে বাড়তি পাওনা ফ্ল্যাটের ব্যালকনি বা ছাদ থেকে জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জনের শোভাযাত্রা দেখা। তাই ‘প্রসেশন রুট’ (যে পথ ধরে শোভাযাত্রা হয়)-এর ধারের আবাসন বিক্রিও হচ্ছে দ্রুত।

তবে, শহরের ভিতরের আবাসনও পড়ে থাকছে না। বছর পাঁচেক আগে ভিতরের যে জমির দাম ছিল কাঠাপ্রতি ১০-১৫ লক্ষ টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ২০-২২ লক্ষ। লাফিয়ে বাড়ছে ফ্ল্যাটের দামও। পুরসভার হিসেবেই গত পাঁচ বছরে আবাসন তৈরি হয়েছে ৫৫টি।

কেন চতুর্দিকে এত আবাসন?

প্রোমোটার বিজয় গুহের মতে, ঐতিহাসিক এবং বর্ধিষ্ণু এই শহরে পুরনো বহু বাড়ি রয়েছে। কিন্তু তা রক্ষণাবেক্ষণের খরচ যে ভাবে বাড়ছে, তাতে অনেকেই ওই বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট তৈরির দিকে ঝুঁকছেন। তা ছাড়া, শহর এখনও যথেষ্ট নিরাপদ বলে ক্রেতারাও এখানে ফ্ল্যাট কিনতে খুব বেশি ভাবছেন না। প্রায় একই বক্তব্য প্রোমোটার বিশ্বনাথ ঘোষালেরও। আর এক প্রোমোটার আশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, “চন্দননগর সাজানো-সুন্দর। এখানকার পরিবেশ মানুষকে আকৃষ্ট করে। তাই ফ্ল্যাটও বাড়ছে।”

আর এই আবাসনের ভিড়েই এ শহরের শান্ত-স্নিগ্ধ সবুজে ছাওয়া পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বহু প্রবীণ বাসিন্দা। যেমন হাটখোলার বাসিন্দা, বছর সাতষট্টির তরুণ রায়ের আক্ষেপ, “শহরকে যে ভাবে সাজানো হচ্ছে, ভাল লাগছে। কিন্তু যে হারে ফ্ল্যাট বাড়ছে, তাতে সবুজ হারাচ্ছে।” প্রাক্তন শিক্ষিকা সুষমা বসুর খেদ, “যে হারে ফ্ল্যাট বাড়ছে, তাতে শহরের ঐতিহ্য বাধা পাচ্ছে। উন্নয়নের নামে সবুজ ধ্বংস হচ্ছে।” কয়েকশো বছরের পুরনো একটি বাড়িতে থাকেন বোসপাড়ার সৌম্যদেব বসু। তবে, অনেক পুরনো বাসিন্দার মতো বাড়ি প্রোমোটারদের হাতে দিতে তিনি নারাজ। তাঁর কথায়, “বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যা হয় ঠিকই। কিন্তু প্রোমোটারদের হাতে দেব না। যত দিন পারব বাড়িটা রাখব।”

আবাসন তৈরির জন্য কিছু গাছ যে কাটা পড়ছে, তা মেনে নিয়েছেন চন্দননগরের মেয়র রাম চক্রবর্তী। তবে, একই সঙ্গে তিনি দাবি করেছেন, পুরসভার উদ্যোগে সমানতালে বৃক্ষরোপণও চলছে। তিনি বলেন, “গত অর্থবর্ষে ৪৭ লক্ষ টাকায় আমরা বনসৃজনের কাজ শুরু করি। যাঁরা আবাসন করছেন, তাঁদের সবুজ বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের গাছ লাগাতেই হবে।”

ভিন্ রাজ্য, ভিন্ এলাকার মানুষের ভিড় শহরে বাড়লেও এখনও এখানে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা সে ভাবে না হওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে অনেকেরই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চন্দননগর-সহ হুগলি জেলার ঐতিহাসিক স্থানগুলিকে ঘিরে পর্যটনে গুরুত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এখনও এই শহরে থাকার জায়গা সে ভাবে নেই। দেরিতে হলেও সম্প্রতি শহরের একটি অতিথিশালার খোলনলচে বদলে ফেলার কাজ শুরু করেছে পুরসভা। কুঠির মাঠ এলাকায় ‘স্বাগতম’ নামের ওই ভবনকে মোট ৫০ লক্ষ টাকায় দু’টি পর্যায়ে ঢেলে সাজা হচ্ছে। প্রেক্ষাগৃহ, ইন্ডোর স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে এক তলায়। দোতলায় নির্মাণ করা হচ্ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অতিথিশালা। রানিঘাটের কাছেও একটি অতিথিশালা তৈরির পরিকল্পনা করেছে পুরসভা।

অতিরিক্ত প্রতিবেদন: তাপস ঘোষ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE