চলছে বিকিকিনি । ছবিটি তুলেছেন রমাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়।
এখন আর গরুর গাড়ির ক্যাঁচ ক্যাঁচ নেই।
শোনা যায় না মাঝিমল্লা, মুটে-মজুরের হাঁকডাক।
দেখা যায় না পালকি, ময়ূরপঙ্খী নৌকা বা খড়মের বিকিকিনি।
দামোদরের পাড়ে আমতার ময়রাপাড়ার হাটতলার হাট স্থান পাল্টে বাজারের চেহারা নিয়েছে। নাম হয়েছে মেলাইচণ্ডী বাজার। আশপাশে গজিয়ে উঠেছে আরও হাট-বাজার। ফলে, মেলাইচণ্ডী বাজারেও আর আগের মতো ভিড় হয় না। তবু অতীতের সেই হাটের কথা এখনও এখানকার প্রবীণ মানুষদের মুখে মুখে ফেরে। এক সময়ে এতটাই খ্যাতি ছড়িয়েছিল ওই হাটের।
এলাকার প্রবীণ মানুষেরা জানান, আমতা বন্দর সংলগ্ন ওই হাট প্রায় চারশো বছরের প্রাচীন। মেলাইচণ্ডী মন্দিরকে ঘিরেই তা গড়ে ওঠে। পান, ধান, আলু, পাটের পাইকারি ও খুচরো বিক্রি ছাড়াও নানা ধরনের পালকি, ময়ূরপঙ্খী নৌকা, খড়ম-সহ নানা কুটির শিল্প-সামগ্রীর বিকিকিনির জন্যেও বিখ্যাত ছিল ময়রাপাড়ার হাট। বড় বড় নৌকো বোঝাই করে ওই সব মালপত্র আসত আমতা বন্দরে। নদীপথে বর্ধমান, হুগলি, চাঁপাডাঙা থেকে ধান, আলু, কুমড়ো, পেঁয়াজ আসত। গরুর গাড়িতে চাপিয়ে বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে আসা হত হাটে। এ ছাড়া, উদয়নারায়ণপুর, জগৎবল্লভপুর, আমতা, জয়পুর, ঝিখিরা-সহ আশপাশের নানা এলাকার তাঁতের জিনিস, মাদুর আর পিতল-কাঁসার জিনিসপত্রও আসত। কেনাকাটার হইচইয়ে গমগম করত গোটা হাট। হাওড়া ও কলকাতার নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ত হাটের পণ্য। এমনকী, মার্টিন কোম্পানির ট্রেনে চড়েও দূর থেকে লোকজন কেনাকাটা করতে আসতেন। এখানকার পালকি চড়েই কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ির লোকজন যাতায়াত করতেন বলে দাবি করেন কেউ কেউ।
আমতার ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চর্চা করছেন প্রবীণ বাসিন্দা এস মনিরুদ্দিন। তিনি জানান, দেবী চণ্ডীর শিলাখণ্ডটি আমতার ময়রাপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেটিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল হাট। সেই সময়ে হাটবারে কমপক্ষে দু’হাজার লোকের আনাগোনা হত। প্রায় ১০০ বছর ওই এলাকায় হাট রমরমিয়ে চলেছে। দামোদরের গুরুত্ব কমার সঙ্গে সঙ্গে হাটটিরও গুরুত্ব কমতে থাকে। কয়েকশো বছর পরে সেই হাট সরে যায় স্থানীয় বাসিন্দা নন্দলাল সরখেলের উদ্যোগে। আগেকার সেই হাট এবং বর্তমান বাজার পরিচালনা করে ‘মেলাইচণ্ডীমাতা দেবোত্তর এস্টেট কমিটি’। কমিটির সম্পাদক বিশ্বনাথ সরখেল জানান, কয়েকশো বছর আগে জটাধারী চক্রবর্তী নামে এক ব্রাহ্মণ স্বপ্নাদেশে দামোদরের পশ্চিম পাড়ে জয়ন্তী গ্রামে দেবী চণ্ডীর পুজো দিতে যেতেন। প্রতিদিন নদী পেরিয়ে যেতে অসুবিধায় পড়তেন তিনি। পরে ফের স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি জয়ন্তী থেকে দেবী চণ্ডীর শিলাখণ্ডটি নিয়ে আসার সময় ময়রাপাড়া এলাকায় কিছু ক্ষণের জন্য রেখে বিশ্রাম করেন। পরে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। এর পরে কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত নামে এক ব্যবসায়ী মন্দির স্থাপন করে দেবীর প্রস্তরখণ্ডটি স্থাপন করেন। বাজার কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, এই বাজারটির বয়সও কয়েকশো বছর হয়ে গেল। বর্তমানে সেখানে ছোট-বড় দোকান, সব্জি-বাজার, পাইকারি বাজার মিলিয়ে ৩৫০ জন ব্যবসায়ী রয়েছেন। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে আশপাশে হাট-বাজারের সংখ্যা বেড়েছে। তাই এখন মেলাইচণ্ডী বাজারে ব্যবসার পরিমাণ অনেকটাই কমে গিয়েছে বলে সেখানকার ব্যবসায়ীদের দাবি। কমিটির সম্পাদক বিশ্বনাথ সরখেল বলেন, “ব্যবসায়ীদের বসার ছাউনি করে দিয়েছি। শৌচালয়েরও ব্যবস্থা হয়েছে। বাজারটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য পরিকাঠামোগত উন্নয়নের যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছি।” ৫০ বছর ধরে ওই বাজারে চায়ের ব্যবসা করছেন চাঁদু সাউ। তিনি বলেন, “এক সময় এখানে এত বেশি ধান আসত যে তা গুদামে রাখার জায়গা হত না। পড়ে থাকত বাজারেই। সে ব্যবসা এখন কোথায়!” কৃষ্ণপদ দত্ত নামে আর এক প্রবীণ ব্যবসায়ীর আক্ষেপ, “দূরদূরান্ত থেকে এখন মালপত্র আসে না। আশপাশের ব্যবসায়ীরা কাঁচা আনাজ নিয়ে আসেন। শহরের বড় বড় ব্যবসায়ীরা চাষির কাছ থেকে সরাসরি মাল কিনে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। এখন আর আগের মতো রমরমা নেই।” প্রতিদিন নিয়ম করে বাজারে আসেন এলাকার প্রবীেণেরা। কেনাকাটা হোক-না হোক, আড্ডা হয়। আর সেই আড্ডাতে ঘুরেফিরে আসে পুরনো দিনের হাটের কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy