তৃণমূলের শীর্ষনেতাদের কেউ কেউ পুরভোটের প্রচারে পুরসভাকে বিরোধীশূন্য করার ডাক দিয়েছিলেন। দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় বলেছিলেন, তাঁরা যেহেতু রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছেন, তাই পুরসভাতেও ক্ষমতায় থাকলে উন্নয়নের সুবিধা হবে।
কিন্তু হুগলিতে এ বার ১৩টি পুরসভায় তাঁরা ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে বলে দাবি করলেও ভোটের ফল ঘোষণার আগের দিন জেলা তৃণমূল নেতাদের অনেকেরই আশঙ্কা, পুরবোর্ড আদৌ বিরোধীশূন্য হবে কিনা! কেননা, তাঁদের বিঁধছে নির্দল-কাঁটা এবং বিরোধীদের প্রতিরোধ। তাঁরা মনে করছেন, নির্দলদের ভোট কাটাকাটি ও প্রতিরোধের সুবাদে জেলার বেশ কয়েকটি পুরসভায় সম্মানজনক আসন পাবে বিরোধীরা। কোথাও আবার সরাসরি জিতে যেতে পারেন নির্দল প্রার্থীরা।
প্রশাসন সূত্রের খবর, হুগলিতে ১৩টি পুরসভায় এ বার মোট ৩০০টি ওয়ার্ড। গত বার কয়েকটি ওয়ার্ড কম ছিল। তার মধ্যে ২৪০টি ছিল তৃণমূলের দখলে। গত পুরভোটে ১১টি পুরসভা প্রথমে দখল করে তারা। পরে বিরোধীদের দল বদলের জেরে শ্রীরামপুর এবং আরামবাগও তাদের কব্জায় আসে। এ বার প্রচারের শুরু থেকে শাসকদলের দাপটে সিপিএম, কংগ্রেস বা বিজেপি সে ভাবে দাঁত ফোটাতে পারেনি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নির্দলেরা।
তৃণমূলের যাঁরা টিকিট পাননি, তাঁদের বিদ্রোহ সামাল দিয়ে নিরস্ত করাই ছিল শাসকদলের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ। শাসকদল মরিয়া চেষ্টা করলেও কিন্তু তা পুরোপুরি সামাল দিতে পারেনি। গঙ্গাপাড়ের পুরসভা উত্তরপাড়া থেকে বাঁশবেড়িয়া— সর্বত্রই দলীয় টিকিট না পেয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। কমবেশি একই চিত্র দেখা যায় ডানকুনি, তারকেশ্বর এবং আরামবাগে। যদিও তারকেশ্বর এবং আরামবাগ ইতিমধ্যেই শাসকদলের ঝুলিতে চলে গিয়েছে। কিন্তু তারকেশ্বরের পাঁচটি ওয়ার্ডে এবং আরামবাগের তিনটি ওয়ার্ডে ভোট হয়েছে। এ বার সেই সব ওয়ার্ডের বিরোধীরা জায়গা পায় কিনা, তা বোঝা যাবে আজ। একই সঙ্গে বোঝা যাবে বিরোধীদের প্রচারে আদৌ কতটা মানুষের মনে প্রভাব ফেলল!
কেননা, মনোনয়ন পর্বে বহু পুরসভা থেকেই বিরোধীরা প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, শাসকদলের সন্ত্রাসে তাদের প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য হন। উত্তরপাড়া পুরসভার কয়েকটি ওয়ার্ডে এ বার তৃণমূলের দলীয় কাউন্সিলররা টিকিট পাননি। তার উপর সেখানে দলের দীর্ঘদিনের কর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ টিকিটের প্রত্যাশা করেছিলেন। তাঁরাও তা পাননি। বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে নির্দলেরা দাঁড়িয়ে গিয়েছেন। একই ভাবে কোন্নগর, রিষড়া, ডানকুনি, শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটি সর্বত্রই কমবেশি একই চিত্র। আবার কোথাও দল চাইলেও গোষ্ঠী-বিবাদের জেরে ব্লক স্তরের নেতাদের চাপে শেষে টিকিট পাননি দলীয় কাউন্সিলররা। তা নিয়ে ক্ষোভও কম ছিল না। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের অনুগামীরা নির্দল হয়ে দাঁড়ান।
তাই ভোট-প্রক্রিয়া মিটতেই ফলাফল নিয়ে নিজেদের মধ্যে চুলচেরা হিসেবে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তৃণমূল নেতারা। তাঁরা ঠারেঠোরে স্বীকারও করছেন, দলের গোষ্ঠী-বিবাদের জেরে জেলার বেশ কয়েকটি পুরসভায় শেষ পর্যন্ত বাড়া ভাতে ছাই পড়তে পারে। জেলার কয়েক জন বড় মাথাও হেরে যেতে পারেন নির্দলের ভোট কাটাকাটির অঙ্কে। চুঁচুড়া, বৈদ্যবাটি, উত্তরপাড়া, বাঁশবেড়িয়া, চাঁপদানি, আর ডানকুনি পুরসভায় কিছু আসন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে তৃণমূল নেতারা।
তৃণমূলের জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্ত অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘আমরা জেলায় প্রতিটি পুরবোর্ডেই ক্ষমতা ধরে রাখত পারব। প্রতিটি পুর এলাকায় যে গতিতে উন্নয়নের কাজ করেছি, তাতে ভর করেই আমরা ফের ক্ষমতায় আসব। বিরোধীরা কোনও ভাবে হালে পানি না পেয়ে সন্ত্রাসের গল্প করছে।’’ দলের জেলা সভাপতি ওই দাবি করলেও নেতাদের একাংশ মনে করছেন, এ বার জেলায় মোট আসনের ভিত্তিতে তাদের আসন কিছুটা কমতে পারে। যে সব ওয়ার্ডে আগের বারের জয়ী কাউন্সিলরদের টিকিট দেওয়া যায়নি, সে সব ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বেই।
তবে আশার আলো দেখছেন বিরোধীরা। তারা মনে করছে, আগের বারের চেয়ে জেলায় মোট আসন তাদের বাড়বে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘তৃণমূল পরিকল্পিত ভাবে বাইরে থেকে গুন্ডা এনে পুরভোটে অবাধে সন্ত্রাস চালিয়েছে। গত পঞ্চায়েত এবং লোকসভার ভোটে আমাদের কর্মীরা সে ভাবে প্রতিরোধ করতে পারেননি। এ বার কিন্তু আমরা প্রতিরোধে গিয়েছি। তার উপর শাসকদলের নিজেদের মধ্যে মারামারি জেরে নির্দলেরা দাঁড়িয়ে পড়ায় ভোট কাটাকাটিতে বাড়তি কিছুটা সুবিধা আমরা পাব।’’
একই সুর বিজেপিরও। জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি স্বপন পাল মনে করছেন, ‘‘শাসকদল সন্ত্রাস চালালেও যে ভাবে আমাদের প্রার্থীরা লড়ে গিয়েছেন, তাতে ওই সব এলাকায় ফল ভাল হবে। শ্রীরামপুরেও গত লোকসভায় আমরা এগিয়ে ছিলাম। ওখানেও ভাল ফলের আশা করছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy