মহিলাদের হাতে রাত পাহারার সরঞ্জাম তুলে দিচ্ছে পুলিশ। —নিজস্ব চিত্র।
স্বামী ট্রেনচালক। অনেক সময় রাতে বাড়ি ফিরতে পারেন না। কিশোরী মেয়েকে নিয়ে একাই বাড়িতে থাকেন সুপর্ণা সাহা। সামনে জিটি রোড, রেল স্টেশন। রাতভর বাইরের লোকের আনাগোনা। মাসখানেক আগেই গভীর রাতে জানলার সামনে কিছু অপরিচিত ছেলে জড়ো হয়েছিল। ভয়ে পেয়ে গিয়েছিলেন সুপর্ণা। শেষে মোবাইলে পড়শিদের ডাকতে ছেলেগুলো গা-ঢাকা দেয়। দিন কয়েক আগে সন্ধে নাগাদ কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলেন এক তরুণী। রাস্তায় তাঁর মোবাইল ফোন ছিনতাই করে দুষ্কৃতীরা। এ ছাড়া মাঝেমধ্যেই রাতবিরেতে গ্রামের ঝোপজঙ্গল দিয়ে চলাফেরা করে অচেনা লোকজন। রাত বাড়লে আড়ালে-আবডালে বসে যায় মদ-জুয়ার আসর। অঞ্চলের এ হেন পরিস্থিতির কথা পুলিশকে জানানোর পরেও অবস্থার বিশেষ হেরফের হয়নি বলে অভিযোগ।
আর তাই জেদ চেপে যায়। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ গ্রামের মহিলারা ঠিক করেন দল বেঁধে নিজেরাই মাঠে নামবেন। আর তারই পথ ধরে এখন আস্ত একটি প্রমীলা বাহিনীর পাহারায় এলাকার নিরাপত্তা। লাঠি হাতে, বাঁশি বাঁজিয়ে রাত পাহারায় নেমে পড়েছেন তাঁরা। হুগলির আদিসপ্তগ্রামের তিরিশ বিঘা ঘোষপা়ড়া এলাকায় সাহসী এই মহিলা গ্রামরক্ষী বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছে পুলিশও। জায়গাটি মগরা থানার অধীন। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, পাশেই জিটি রোড, আদিসপ্তগ্রাম রেল স্টেশন। অথচ গ্রামের রাস্তাঘাটের হাল খুবই খারাপ। রাস্তায় আলোর বালাই নেই। এ ব্যাপারে পঞ্চায়েত কিছুই করেনি। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বহিরাগতরা অবাধে ঘুরে বেড়ায়। সমাজবিরোধীরা পরিস্থিতির সুযোগ নেয়।
গত রবিবার মগরা থানার আধিকারিকরা ওই এলাকায় গ্রামবাসীদের নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানে মহিলাদের সংখ্যাই ছিল বেশি। চুরি এবং রাতবিরেতে বাইরের লোকের আনাগোনা ঠেকাতে পুলিশের তরফে নৈশপ্রহরার কথা উঠতেই মহিলারা এক বাক্যে জানিয়ে দেন, প্রয়োজনে তাঁরাই এ কাজে কোমর বাঁধবেন। সেই মতো মঙ্গলবার রাত থেকেই হইহই করে গ্রাম পাহারায় নেমে পড়েছেন গ্রামের বউ-মেয়েরা। মঙ্গলবার রাতে মগরা থানার ওসি সুখময় চক্রবর্তী সেখানে গিয়ে মহিলাদের হাতে টর্চ, লাঠি, বাঁশি তুলে দেন। তিনি জানান, পাহারার জন্য গ্রামবাসীদের সঙ্গে দু’জন মহিলা পুলিশও নিয়োগ করা হবে। জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, পুলিশের পক্ষে প্রতিদিন সব জায়গায় নজর রাখা সম্ভব হয় না। নিজেদের গ্রামের জন্য মহিলাদের এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি। পুলিশের তরফে ওঁদের সব রকম সাহায্য করা হবে।’’
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, জনা পঞ্চাশ মহিলা পাহারায় চর্চ, লাঠি নিয়ে এলাকায় ঘুরছেন। দু-এক জনের হাতে তির-ধনুকও ছিল। স্কুলশিক্ষিকা সরস্বতী হাঁসদা বলেন, ‘‘গ্রামে অচেনা লোকের আনাগোনা বে়ড়েছে। চুরি-ছিনতাই হচ্ছে। তাই সবাই মিলে রাত জাগার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’
কিন্তু গ্রাম পাহারায় মহিলারা কেন?
সরস্বতীদেবীর কথায়, ‘‘গ্রামের শৃঙ্খলা বজায় রাখা কি একা পুরুষদের দায়িত্ব? আমার স্বামী রেলকর্মী। সারাদিন খাটাখাটনির পরে রাতে যদি একটু বিশ্রাম পান, ক্ষতি কোথায়!’’ সুপর্ণাদেবী বলেন, ‘‘গ্রামে মেয়েদের একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে। কমিটিতে ৫৯ জন আছেন। স্কুলছাত্রী, গৃহবধূ, চাকরিজীবী সবাই এখানে এককাট্টা হয়ে কাজ করব। মদ্যপ, জুয়াড়ি বা চোর-ছিনতাইবাজ দেখলেই ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে। অসামাজিক কাজকর্ম বন্ধ করবই।’’ সুপর্ণাদেবীর স্বামী, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী জয়ন্তকুমার সাহা বলেন, ‘‘কাজ থেকে ফিরতে প্রায়ই অনেক রাত হয়। আবার অনেক সময় ফিরতেও পারি না। স্ত্রী যদি রাত পাহারা দেয় আমার কোনও আপত্তি নেই। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের প্রভেদ করা অর্থহীন।’’
আর এক গ্রামবাসী গৌতম ঘোষ বলেন, ‘‘মহিলারা পাহারা দিলে আপত্তিটা কোথায়? মাঝেমধ্যে মহিলাদের বিশ্রাম দিয়ে পুরুষরাও পাহারা দিতে পারে। এতে গ্রামে সুস্থ পরিবেশ বজায় থাকবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy