জয়ের আনন্দে সবুজের সমারোহ। হুগলিতে নিজস্ব চিত্র।
তখনও চূড়ান্ত ঘোষণা হয়নি। তবে, হেরে যাওয়ার ছবিটা স্পষ্ট ধরা পড়ছিল অজয়প্রতাপ সিংহের শরীরী ভাষায়। সুঠাম চেহারার যুবকের চোখ-মুখ থেকে তখন যেন অবিশ্বাস ঝরে পড়ছে!
অজয়প্রতাপ সিংহ। বৈদ্যবাটি পুরসভার তৃণমূলের বিদায়ী পুরপ্রধান। গত পাঁচ বছরে দাপটের সঙ্গে চালিয়েছেন পুরসভা। তিনি যখন পুরসভার দায়ভার হাতে নেন, তখন গঙ্গাপারের এই পুরসভার দরজা খোলা রাখাটাই প্রতি দিনের চ্যালেঞ্জ ছিল। কেননা, তিনি দায়িত্বে আসার আগে বিরোধীদের আন্দোলনে জর্জরিত এই পুরসভার ঝাঁপ প্রায়শই বন্ধ থাকত। লাফিয়ে লাফিয়ে পুরসভার দেনা বেড়েছে। কিন্তু তিনি এসেই পরিস্থিতির সামাল দেন।
ঘটনা হচ্ছে, গত পাঁচ বছরে এক দিনও পুরসভা বন্ধ রাখতে হয়নি। একটি স্মারকলিপি পর্যন্ত পড়েনি বিরোধীদের। উৎসবের মরসুমে রাস্তার ভিড় সামলাতে বা নিমাইতীর্থ ঘাটে নিরাপত্তা বাড়াতে সিভিক ভলান্টিয়ার, গ্রিন পুলিশ নিয়োগ করা থেকে শুরু করে এলাকায় গাছ লাগানো, পরিষেবা নিয়ে কথা বলতে মানুষের দোরে দোরে ঘোরা— চেষ্টা কম করেননি। ঘনিষ্ঠ মহলে বলতেন, সুযোগ পেলে আগামী দিনে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন শহরটাকে। তাঁকে ঘিরেই ফের পুরবোর্ড গড়ার স্বপ্ন দেখছিল শাসক দলের একটা অংশ।
কিন্তু সেই স্বপ্ন সফল হল না। তাল কাটল নির্দল কাঁটায়। দলের দেওয়া আসন পছন্দ না হওয়ায় অজয়বাবুর বিরুদ্ধেই ‘জোড়া পাতা’ চিহ্ন নিয়ে নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতা প্রবীর পাল। অভিজ্ঞ এই নেতা এক বার উপ-পুরপ্রধানও ছিলেন। ২১ নম্বর ওয়ার্ডে শেষ পর্যন্ত সিপিএম, বিজেপি বা কংগ্রেস নয়, প্রবীরবাবুর সঙ্গেই টক্কর হয় অজয়ের। ভোটের ফল বেরোতে দেখা গেল ছ’শোরও বেশি ভোটে হেরে গিয়েছেন অজয়বাবু। চওড়া হাসি মুখে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রবীর।
সেই ফলই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না অজয়প্রতাপ। তবে প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে দলের অন্য প্রার্থীদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন প্রকৃত সেনাপতির মতোই। জয়ী প্রার্থীদের বাহবা দিচ্ছিলেন। মুখে বলছিলেন, “এত কাজ করেও কেন জিততে পারলাম না, সেটা মানুষ জানেন। তবে, নিশ্চয়ই কিছু ভাল কাজ আমরা করেছি। তাই তো আবারও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বোর্ড গড়তে চলেছি আমরা।” ভোটের ফল বিশ্লেষণ করে তাঁর ঘনিষ্ঠরা বলছেন, অজয়প্রতাপকে হারাতে অনেকটা শিলিগুড়ি মডেলে তলে তলে অন্য দলগুলো, বিশেষত সিপিএম রামধনু জোট করেছিল। দলের একটা অংশের অন্তর্ঘাতেরও কি শিকার হয়েছেন এই তৃণমূল নেতা? এই গুঞ্জনই এখন চলছে শাসক দলের অন্দন্দরে। পরবর্তী পুরপ্রধান কে হবেন, তা নিয়েও শুরু হয়েছে জল্পনা।
শুধু অজয়প্রতাপ নন, নির্দল কাঁটায় বিদ্ধ হয়েছেন জেলার বাঁশবেড়িয়ার বিদায়ী পুরপ্রধান রথীন্দ্রনাথ দাস মোদক। ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পর থেকে রথীন্দ্রনাথবাবু দল এবং প্রশাসনের কাছে নির্দল প্রার্থী ও তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিলেন তাঁকে প্রচার করতে দেওয়া হচ্ছে না। শেষে দলেরই ব্লক সভাপতি রাজা চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন দলের রাজ্য নেতৃত্বের পরামর্শে। দল ব্যবস্থা নেয় রাজার বিরুদ্ধে। যদিও এর পরেও হুমকি অব্যাহত থাকে বলে রথীন্দ্রনাথবাবুর অভিযোগ। দলের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি রাজা অবশ্য সাফাই গেয়েছেন, কোনও হুমকিই তাঁরা দেননি।
পরিস্থিতি অবশ্য এমন জায়গায় গড়ায় যে, রথীন্দ্রনাথবাবু পুলিশি প্রহরায় প্রচারে নামেন। যদিও শেষরক্ষা হয়নি। নির্দল প্রার্থী পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে হেরে গিয়েছেন তিনি। যদিও পুরবোর্ডের ক্ষমতা ধরে রেখেছে তাঁর দল। ফল ঘোষণার পরে রথীনবাবুর প্রতিক্রিয়া, “যা জানানোর দলকেই জানিয়েছি।”
দলের একাংশের এখন উদ্বেগ অন্য কারণে। দলের প্রবীণ নেতা হেরে গিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু পুরপ্রধান নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগামী ১১ তারিখে ঘটনা কোন দিকে মোড় নেয়, তা নিয়েই শুরু হয়েছে জল্পনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy