সম্মান: মূর্তিতে মালা দিচ্ছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র
৯০ বছর আগে বাড়িতে আচার তৈরির ব্যবসা শুরু করেছিলেন কোন্নগরের এক তরুণ। পুঁজি ছিল সাকুল্যে ৩০ টাকা। ঝাঁকা মাথায় নিজেই আচার ফেরি করতেন। পরে কারখানা গড়েন। সে দিনের তরুণ শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র মারা গিয়েছেন ৩৬ বছর আগে। কিন্তু তাঁর হাতেগড়া আচার ব্যবসার এখন বার্ষিক লেনদেন কয়েক কোটি টাকা। এই সংস্থার তৈরি হরেক স্বাদের আচার, সস, রান্নার মশলা বিদেশের বাজারে সমাদৃত।
সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা, প্রয়াত শৈলেন্দ্রকৃষ্ণের ১১৩ তম জন্মদিনে তাঁর আবক্ষ মূর্তি বসল কারখানা চত্বরে। মঙ্গলবার মূর্তির আবরণ উন্মোচন করলেন দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে উঠে এল স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে বাঙালি শিল্পোদ্যোগীর হাতে ব্যবসার জন্ম ও বেড়ে ওঠার কাহিনি।
শৈলেন্দ্রর বড় ছেলে ও সংস্থার চেয়ারম্যান, সমরেন্দ্রনাথ মিত্র জানান, শৈলেন্দ্রর জন্ম কোন্নগরেই। ১৯০৫ সালে। চোদ্দ বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ হয়। তখন তিনি অথৈ জলে— ম্যাট্রিকের আগেই পড়া ছাড়তে হয়। টাইপরাইটিং শিখে কলকাতায় আচারজাতীয় খাদ্য প্রস্তুতকারক সংস্থায় চাকরি নেন।
সেই শুরু।
১৯২৮ সালে চাকরি ছেড়ে নিজের বাড়িতে আচারের ব্যবসা খোলেন ৩০ টাকা সম্বল নিয়ে। সঙ্গী দু’জন— স্ত্রী আর শাশুড়ি। তখন ব্রিটিশ আমল। ‘সাহেব’দের মধ্যে চাটনি, আচার খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। ট্রেনে চেপে হাওড়া যেতেন শৈলেন্দ্র। তার পরে এক পরিচিত মুটের সঙ্গে ঝাঁকা মাথায় হেঁটে হেঁটে কলকাতা শহরের সাহেবপাড়ায় আচার ফেরি করতেন।
ক্রমে ব্যবসা বড় হয়। ১৯৩৮-৩৯ সালে তাঁর তৈরি আচারের প্রথম বিদেশযাত্রা। মাল্টা এবং জিব্রাল্টারে আচার রফতানি করলেন। পরে কলকাতার নারকেলডাঙায় এবং মানিকতলা মেইন রোডে কারখানা তৈরি করলেন। মাঝে ব্যবসায় সমস্যা হলেও কাটিয়ে ওঠেন। ১৯৫০ সালে ফের মাল্টা, জিব্রাল্টারে আচার পাঠান। ১৯৫৫ সালে নিজে প্রথম বিদেশ যান। ইংল্যন্ড-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, আমেরিকা, কানাডা, সিঙ্গাপুরের মতো জায়গায় বাজার তৈরি করেন। সেই সময়েই কোন্নগরে বাড়ির কাছেই হারাণ চন্দ্র ব্যানার্জি লেনে (অধুনা শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র সরণি) ১০ বিঘে জমি কিনে কারখানা তৈরি করেন। তখন থেকে এখানেই কারখানা চলছে।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করেছেন। ১৯৮২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ‘কাস্টমার-মিট’ করতে গিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শৈলেন্দ্র মারা যান। বর্তমানে ছেলে সমরেন্দ্রনাথ, অমরেন্দ্রনাথ এবং তাঁদের ছেলেরা ব্যবসা দেখেন। তখন কারখানায় জনা পঞ্চাশ কর্মী ছিলেন। এখন কারখানা আধুনিক হয়েছে। বেশির ভাগ জিনিস মেশিনে তৈরি হয়। বর্তমানে প্রায় ১২৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। পরোক্ষ ভাবে আরও কয়েকশো।
স্থানীয় বাজারে এমনকি দেশের কোনও বাজারে মিত্রদের আচার বিক্রি হয় না। সমরেন্দ্র জানান, ৭০ সাল পর্যন্ত দেশের বাজারেও আচার বিক্রি হত। কিন্তু বিদেশের বাজারে চাহিদা বাড়ায় ১০০ শতাংশ দ্রব্যই বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাহিদা রয়েছে এখানে তৈরি আচারের। কদর বেশি আমের আচারের। এক সময় যশোর (তখন অবিভক্ত বাংলায়) থেকে আম আসত। পরে মালদহ থেকে আম আনা হত। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকায় আম নিয়ে আসতে ঝামেলা পোহাতে হত। এখন অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে বেশির ভাগ আম আনা হয়। মালদহ থেকেও আসে।
উত্তরপাড়ার বিধায়ক প্রবীর ঘোষাল কোন্নগরেরই বাসিন্দা। তিনি ছিলেন অনুষ্ঠানে। তাঁর কথায়, ‘‘ঝাঁকা মাথায় আচার বেচে যে উচ্চতায় ব্যবসাকে উনি দাঁড় করান,
তা শিক্ষণীয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy