কিলিয়ান এমবাপেদের বিশ্বকাপ জয়ের আশায় বুক বাঁধছে হুগলির চন্দননগর। — নিজস্ব চিত্র।
বিশ্বকাপে চন্দননগরের ‘জগদ্ধাত্রী’ কিলিয়ান এমবাপে! অবাক হচ্ছেন? আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময় তৈরি হয় বটে। কিন্তু এতে অবাক হওয়ারও কিছু নেই।
গোটা বাংলা যখন দুর্গাপুজোয় মাতে, চন্দননগর তখন অপেক্ষায় থাকে দেবী জগদ্ধাত্রীর আগমনের। প্রায় গোটা বাংলা যখন বিশ্বকাপ ফুটবলে মেসি-তাড়িত হয়ে আর্জেন্টিনার জয় চাইছে, তখন চন্দননগর ফ্রান্সের হয়ে গলা ফাটাতে তৈরি। রবিবারের ফাইনালে চন্দননগরের ‘কালো ঘোড়া’ মেসি নন, এমবাপে। জগদ্ধাত্রী পুজোর মতোই বিশ্বকাপ ফুটবলের আবেগেও ‘আলাদা’ অতীতের ফরাসডাঙা।
২০১৮ সালের রুশ বিশ্বকাপে এই ফ্রান্সের হাতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টাইনদের বিশ্বকাপ অভিযান। সেই ম্যাচেরও নায়ক ছিলেন এমবাপে। ৬৪ মিনিট এবং ৬৮ মিনিটে পর পর দু’টি গোল করে চুরমার করে দিয়েছিলেন মেসিদের স্বপ্ন। অনন্য লড়াই করলেও শেষ পর্যন্ত ৪-৩ গোলে হার মানতে হয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। চার বছর পর বিশ্বকাপের ফাইনালে আবার মুখোমুখি সেই দুই দল। এ বার কি জিতে যাবে ‘মেসি ম্যাজিক’? না কি পর পর দু’বার এমবাপের হাতে উঠবে বিশ্বকাপ? চন্দননগর চায় দ্বিতীয়টা।
গ্রুপ পর্ব থেকে ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে আর্জেন্টিনার সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলা দেখার পর প্রায় গোটা বাংলা মজে আছে মেসি ম্যাজিকে। কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে বাঙালির আবেগের অন্য আধার ব্রাজিল। ফলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা লড়াইও নেই। নেমার থেকে মেসিতে ঢলে পড়েছে বাঙালি। আরও বেশি করে, কারণ এটাই মেসির শেষ বিশ্বকাপ।
কিন্তু চন্দননগর সেই আবেগের অংশ নয়। উল্টো পথে হাঁটছে একদা ফরাসি উপনিবেশ। শহরবাসীর সমর্থনের পাল্লা ঢলে আছে প্যারিসের দিকে। চন্দননগরের তরুণ বিক্রমজিৎ সামন্তের কথায়, ‘‘সকলে যখন দুর্গাপুজো নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তখন আমরা জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য অপেক্ষা করি। আমরা এমনই। সকলে যখন মেসি আর আর্জেন্টিনার জয় চাইছেন, তখন আমরা চাইছি বিশ্বকাপ জিতুক ফ্রান্স। কাপ উঠুক এমবাপের হাতে।’’
ফরাসিরা চন্দননগরের শাসক হলেও তাদের ভাবমূর্তি ব্রিটিশদের মতো ছিল না। তাই এখনও চন্দননগরের মানুষ পরাধীনতার ইতিহাসকে খুব খারাপ নজরে দেখেন না। আবার এই চন্দননগরই বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য আশ্রয়স্থলও হয়ে উঠেছিল। ১৯০৫ সালের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের হীন ষড়যন্ত্র ‘বঙ্গভঙ্গ’ কেন্দ্র করে ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যেই ‘বিপ্লবতীর্থ’ হয়ে উঠেছিল চন্দননগর। রাসবিহারী বসু, কানাইলাল দত্তের চন্দননগর গোপন আস্তানা হয়ে উঠেছিল অরবিন্দ ঘোষেরও। ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে বিপ্লবী মতিলাল রায়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। বার হন ‘শ্রী অরবিন্দ’ হয়ে। বিপ্লবী হয়ে যান ঋষি। এ সব নিয়ে চন্দননগরের গল্পের অন্ত নেই। ফলে ফরাসিদের নিয়েও ভাললাগাও রয়েছে।
রবিবার রাত সাড়ে ৮টায় শুরু বিশ্বকাপের ফাইনাল। তার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি সেরে রাখছে চন্দননগর। শহরের বিভিন্ন এলাকায় টাঙানো হবে বড় পর্দা। ফ্রান্সের পতাকা বানানোর ধুম পড়েছে দোকানে দোকানে। গোটা শহর সেই তিনরঙা পতাকায় মুড়ে শীতের রাতে ছাউনির তলায় সেখানেই প্রিয় দল ফ্রান্সকে সমর্থন জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে চন্দননগর। পাশাপাশি, গঙ্গার পাশে ফরাসি স্থাপত্য স্ট্র্যান্ডের আড্ডায় অথবা চায়ের দোকানে মেসি-এমবাপেকে নিয়ে ঝড় উঠছে।
১৮১৬ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে স্থায়ী ভাবে চন্দননগরের দখল পেয়েছিল ফরাসিরা। সশস্ত্র ও চরমপন্থী আন্দোলনে অতি গোপনে তাঁরা নেতৃত্ব দেন নানা ভাবে। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়। কিন্তু চন্দননগর তখনও ভারতের নয়। ১৯৫০ সালে ভারত সরকারের হাতে চন্দননগর অর্পণ করা হলেও ‘চন্দননগর মার্জার অ্যাক্ট ১৯৫৪’ অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল পশ্চিমবাংলার অংশ হতে।
কিন্তু তবুও কোথায় যেন ফরাসিরা এখনও রয়ে গিয়েছেন চন্দননগরে। এখনও চন্দননগরের অনেক বিদ্যালয়ে ‘তৃতীয় ভাষা’ হিসাবে ফরাসি পড়ানো হয়। কানাইলাল বিদ্যামন্দিরের ফরাসি বিভাগে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় ফরাসি ভাষা। সেক্রেড হার্ট গির্জা-সহ এখনও অনেক ফরাসি স্থাপত্যও রয়ে গিয়েছে। জোড়াঘাটে মানুষ মিলিত হন। লিবার্টি গেট দেখে গর্ব অনুভব করেন, এই দ্বার টপকানোর ক্ষমতা ছিল না ব্রিটিশ পুলিশের। এখনও চন্দননগর সরকারি কলেজকে অনেকে ‘ডুপ্লে কলেজ’ বলে ডাকেন। কারণ, ফরাসি গভর্নর মঁসিয়ে ডুপ্লে ওই কলেজ তৈরি করেছিলেন।
চন্দননগর তাই ফ্রান্সের দিকেই ঢলে আছে। কাতার বিশ্বকাপের ‘বিস্ময়’ মরক্কোকে ২-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছে ফ্রান্স। খেলার শুরুতে হার্নান্ডেজ এবং প্রায় শেষ পর্বে মুয়ানির গোলের সেই রূপকথা এখন উঠে আসছে আড্ডায়। হঠাৎ চেনা কারও সঙ্গে দেখা হলে চন্দননগরবাসী চোখ নাচিয়ে তুলে ধরছেন সেই বীরগাথা— ‘‘কেমন দিলাম! বলুন একবার?’’
রবিবার এমনই আরও একটা রূপকথার অপেক্ষা করছে চন্দননগর। শহরের বিখ্যাত মিষ্টির দোকানে শোভা পাচ্ছে সন্দেশের তৈরি এমবাপের মূর্তি। রবিবার এমবাপের ফ্রান্স চ্যাম্পিয়ন হলে আরও একটা বিশ্বজয়ের সন্দেশের অপেক্ষায় চন্দননগরবাসী। মিষ্টির দোকানের মালিক ধনঞ্জয় দাস বলেই দিলেন, ‘‘ফ্রান্স ফাইনালে উঠেছে বলে আমরা গর্বিত। কারণ, ওদের সঙ্গে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক। ওরা চ্যাম্পিয়ন হলেও আমরা গর্বিত হব। দোকানদারি ছেড়ে এখন ফ্রান্সের খেলা নিয়েই মেতে আছি।’’
শনিবার ফ্রান্সের পতাকা হাতে এমবাপে, জিহুদের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছিল এক ঝাঁক ছাত্র। তাদের মাঝে পাওয়া গেল কানাইলাল বিদ্যামন্দিরের শিক্ষক বিকাশ সাউকে। তাঁর কথায়, ‘‘চন্দননগরের সঙ্গে ফ্রান্সের রক্তের টান। তাই শহরের সকলে মেতে উঠেছে। আমরা আবার বিশ্বকাপ জিতবই।’’
তবে মেসি ছোঁয়া যে একেবারে নেই, তা-ও নয়। চন্দননগর জুড়ে লাল, নীল, সাদার ‘ফরাসি বিপ্লব’-এর মাঝে লড়াই চালাচ্ছেন গুটিকয়েক আজেন্টিনা সমর্থক। তাঁদেরই এক জন শেখ মহসিন আলি। শান্ত মহসিন বললেন, ‘‘মেসি প্রতিটা খেলায় জান লাগিয়ে দিচ্ছে। ও যেমন ফর্মে আছে, তাতে রবিবারই বোঝা যাবে ওস্তাদের মার শেষ রাতে!’’
ম্যাচের ফলাফল যা-ই হোক, হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসকে হুগলির চন্দননগর বার্তা দিচ্ছে বন্ধুতার। ঘোর বিরোধী আর্জেন্টিনা সমর্থককেও চন্দননগর বুকে জড়িয়ে ধরছে ‘মন আমি’ (আমার বন্ধু) বলে।
ফরাসডাঙা চন্দননগরের বার্ষিক উৎসব ছিল ‘ফ্যাস্তা’। যা আদতে ফ্রান্সের জাতীয় দিবসের উৎসব, পালন করা হত ১৪ জুলাই। মশাল দিয়ে সাজানো হত শহর। শোভাযাত্রা বের হত। অনেক মনে করেন, এখন যে আলোর জন্য বিখ্যাত চন্দননগর, তার পিছনেও রয়েছে সেই ফ্যাস্তার ভূমিকা। আগুনের মশাল থেকেই কালক্রমে এসেছে বৈদ্যুতিক আলো। ফ্যাস্তা উৎসবের সময়ে চন্দননগরের স্ট্র্যাণ্ড রোড ফরাসি পতাকা ও নীল, সাদা, লাল ফুলে সেজে উঠত। রবিবারের বিশ্বকাপ ফাইনালের আগেও যেন তেমনই ফ্যাস্তার জন্য সেজেছে স্বাধীন ভারতের চন্দননগর।
এমবাপে বিশ্বকাপ জিতলে অতীতের মশাল আর বর্তমানের আলোকসজ্জা— দুই’ই দেখা যাবে চন্দননগরে। হুবহু চার বছর আগে রাশিয়ায় বিশ্বকাপ ফাইনালের রাতের মতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy