শস্যবিমা তো আছেই। পাশাপাশি চাষিদের স্বাস্থ্যবিমাও চালু করতে চেয়েছিল রাজ্যের কৃষি দফতর। সেই লক্ষে ওড়িশাকে ‘মডেল’ করে প্রকল্পের প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি করে ফেলেছিলেন কৃষিকর্তারা। কিন্তু বাধ সেধেছে রাজকোষ। ভাঁড়ারের টানাটানিতে এখনই স্বাস্থ্যবিমা চালু করা যাবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁদের। ফলে আপাতত হিমঘরে ঠাঁই হয়েছে ওই সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের।
কৃষিকর্তাদের একাংশ অবশ্য বলছেন, ‘‘অদূর ভবিষ্যতে এই প্রকল্প চালু করতেই হবে। কারণ, ইতিমধ্যেই কর্নাটক, তামিলনাড়ু, পঞ্জাব ও ওড়িশার মতো রাজ্যগুলি চাষিদের স্বাস্থ্যবিমার আওতায় নিয়ে এসেছে। আরও পাঁচ-ছ’টি রাজ্যে এর প্রস্তুতি চলছে। অল্প দিনের মধ্যে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারও কৃষকদের জন্য নয়া স্বাস্থ্যবিমা ঘোষণা করতে চলেছে।’’ তাঁরা মনে করেন, এর ফলে শীঘ্রই পশ্চিমবঙ্গের মতো কৃষিনির্ভর রাজ্যে ওই প্রকল্প চালু করার জন্য রাজনৈতিক চাপ তৈরি হবে।
নবান্ন সূত্রের খবর, মাস তিনেক ধরে অন্য রাজ্যগুলির স্বাস্থ্যবিমা খতিয়ে দেখে শেষ পর্যন্ত ওড়িশাকেই বেছে নেয় এ রাজ্যের কৃষি দফতর। এ নিয়ে সেখানকার কৃষিসচিবের সঙ্গে কয়েকপ্রস্ত কথাও হয়। এক কৃষিকর্তা জানান, রাজ্যের সমস্ত কৃষককে পরিবারপিছু এক লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনতে গেলে সরকারকে কত টাকা প্রিমিয়াম দিতে হবে, তা বুঝতে একটি বেসরকারি বিমা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই সংস্থা ওড়িশাতেও বিমার বরাত পেয়েছে। তারাই প্রাথমিক হিসেবনিকেশ করে জানায়, প্রিমিয়াম হিসেবে ৫০০ কোটি টাকার মতো লাগবে বছরে। ওই কৃষিকর্তা জানান, ‘‘কিন্তু অত টাকা আমাদের বাজেটে নেই। তাই পিছিয়েই আসতে হল।’’
অথচ, সরকারি অর্থে দান-খয়রাতির বিরাম নেই। ক’দিন আগেই নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে রাজ্যের আরও চার হাজার ক্লাবকে দু’লক্ষ টাকা করে অনুদান দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে পুরনো-নতুন মিলিয়ে বছরে ১৬০ কোটি টাকা গুনতে হচ্ছে সরকারকে। এর বাইরে মেলা-খেলা-উত্সব-পুরস্কার ও ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ভাতা বাবদও দেদার টাকা বিলোচ্ছে নবান্ন। রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘ভূষণ-বিভূষণ কিংবা টেলি সম্মান-এর মতো অনুষ্ঠানে কেবল অতিথি আপ্যায়নেই ২০-২৫ লক্ষ টাকা উড়ে যায়। এ ছাড়াও রয়েছে যাত্রা উৎসব, সঙ্গীত মেলা ও ‘আহারে বাংলা’-র মতো খাদ্য উৎসব।’’
রাজকোষের অর্থ উড়ছে মাটি উৎসবেও। গ্রামীণ শিল্পীদের হাতের কাজ বিপণনের সুযোগ করে দেওয়ার নামে কমবেশি ৫০ কোটি টাকা খরচ করে গত তিন বছর ধরে পানাগড়ে ওই মেলা করছে সরকার। নবান্নের এক দল অফিসারের বক্তব্য, সম্প্রতি জেলা সফরে বেরিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রকল্পের শিল্যানাসের পাশাপাশি মাছ ধরার জাল থেকে ধামসা-মাদল-সাইকেল— মুক্তহস্তে দান করছেন মুখ্যমন্ত্রী। এমনকী, পুরুলিয়ায় গিয়ে দারিদ্রসীমার উপরের লোকেদেরও দু’টাকা দরে চাল দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। অথচ, কৃষকদের স্বাস্থ্যবিমা চালু করার ক্ষেত্রে আর্থিক টানাটানির দোহাই দেওয়া হচ্ছে। এক অফিসারদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী যেখানে কথায় কথায় নিজেদের সরকারকে ‘মা-মাটি-মানুষের সরকার’ বলে দাবি করেন, সেখানে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি পরিবার সামাজিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিতই থেকে গিয়েছেন।
কী করেছে ওড়িশা?
সেখানকার এক কৃষিকর্তা বলেন, চাষিদের সামাজিক নিরাপত্তা দিতে ২০১৩ সালে বাবার নামে ‘বিজু কৃষক কল্যাণ যোজনা’ নামে স্বাস্থ্যবিমা চালু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক। দারিদ্যসীমাকে মাপকাঠি না-ধরে রাজ্যের সমস্ত (প্রায় ৬০ লক্ষ) কৃষক পরিবারকে ওই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। গৃহকর্তা ছাড়া ওই সুযোগ পাবেন পরিবারের আরও চার জন। এর জন্য প্রতি কৃষক পরিবারকে মাত্র ৩০ টাকা দিয়ে নাম নথিভুক্ত করতে হয়। বাকিটা সরকারের দায়িত্ব। ওড়িশা কৃষি দফতর সূত্রের খবর, গোড়ায় বিমা পরিমাণ ১ লক্ষ টাকা ছিল। এখন তা দেড় লক্ষ করা হয়েছে। নবান্নের হিসেবে, এ রাজ্যে ৭২ লক্ষ কৃষক পরিবার আছেন। পরিবারপিছু ১ লক্ষ টাকা বিমা করলে খরচ হবে বছরে ৫০০ কোটি টাকা।
কৃষি দফতরের অন্য একটি অংশ অবশ্য চাষিদের প্রতি বঞ্চনার অভিযোগ মানতে চাননি। তাঁদের বক্তব্য, সরকারি অর্থে তাঁদের সেচের জল থেকে সার-বীজ-বিদ্যুৎ, সবই দেওয়া হয়। সরকারই ‘আমার ফসল আমার গোলা’ বা ‘আমার ফসল আমার গাড়ি’ প্রকল্পে তাঁদের সব রকম সহায়তা করছে। তবে কৃষি বিপণন দফতর সূত্রের খবর, মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের ‘রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা’-র অর্থেই সব প্রকল্প চলছে। এমনকী মাঠে কাজ করার সময় বাজ পড়লে নিহতের পরিবারকে রাজ্য যে দু’লক্ষ টাকা দেয়, সেটাও কেন্দ্রের অনুদান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy