তিরস্কার হল। রায় হল না। পুরভোটের প্রচারে মাইক বাজানোর অনুমতি স্থগিত হচ্ছে কি না, স্পষ্ট হল না তা-ও। তবে পরিবেশ আদালতের পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা চলাকালীন মাইক বাজিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালাতে হলে সেটা ধাপার মাঠে গিয়েই করা উচিত!
শুক্রবার পুরভোটে মাইক বাজানোর অনুমতি সংক্রান্ত মামলার শুনানিতে এই মন্তব্যের সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয় পরিবেশ আদালতের বিচারপতি প্রতাপ রায় প্রশ্ন তোলেন, রাজ্য নির্বাচন কমিশন পরীক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা ভাবছে না কেন?
কলকাতা-সহ সারা রাজ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে প্রকাশ্যে মাইক বাজানোর উপরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। রাজ্যের পরিবেশ দফতর এবং পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ২০১১ সালের এপ্রিলে জারি করা এক নির্দেশিকা অনুযায়ী সব বোর্ড ও কাউন্সিলের পরীক্ষা শুরুর তিন দিন আগে থেকে পরীক্ষা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত মাইকের ব্যবহার নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও সিবিএসই-র দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার মধ্যেই পুরভোটের প্রচারে মাইক বাজানোর অনুমতি দিয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। তা নিয়ে প্রবল সমালোচনা চলছে বিভিন্ন শিবিরে। কলকাতা হাইকোর্টে মামলা হয়েছে। আর কলকাতায় জাতীয় পরিবেশ আদালতের পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চে মামলা করেছেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। কমিশন কোন অধিকারে পরীক্ষার মধ্যে ভোট-প্রচারে মাইক ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে, সেই ব্যাখ্যা তলব করেছে পরিবেশ আদালত।
আর এ দিন সেই ব্যাখ্যা দিতে গিয়েই বিচারপতির ভর্ৎসনার মুখে পড়ে কমিশন। রাজ্যে মাইক বাজানো সংক্রান্ত আইনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কমিশনের আইনজীবী নয়নচাঁদ বিহানি বলেন, মানুষের বসবাস রয়েছে, এমন এলাকাতেই শুধু মাইক বাজানোর উপরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। শুনেই আদালত প্রশ্ন তোলে, কলকাতায় কোথায় মানুষের বসবাস নেই? এই প্রসঙ্গেই মাইক বাজাতে হলে ধাপার মাঠে গিয়ে বাজানো উচিত বলে মন্তব্য করেন বিচারপতি রায়। ভোট-প্রচারে মাইক বাজানোর ছাড়পত্রকে কেন্দ্র করে আদালতে কার্যত ভর্ৎসিত হতে হয় কমিশনকে।
কিন্তু আদালত রায় না-দেওয়ায় পরীক্ষার্থীদের মাইক-যন্ত্রণার সুরাহা হয়নি। ১৮ এপ্রিল কলকাতায় পুরভোট। সে-দিন এবং তার পরেও পরীক্ষা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এ দিন দু’দফায় মামলার শুনানি হয়। প্রথম দফায় বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দেড়টা। তার পরে বেলা ৩টেয় শুরু হয়ে বিকেল ৪টে পর্যন্ত। কমিশনের ব্যাখ্যায় আদালত সন্তুষ্ট না-হওয়ায় প্রাথমিক ভাবে স্থির হয়েছিল, এ দিনই রায় ঘোষণা করা হবে। কিন্তু কমিশনের আইনজীবী আদালতের কাছে সময় চান। পরিবেশ আদালতের বিচারপতি প্রতাপ রায় ও বিশেষজ্ঞ-সদস্য পি সি মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ তা মঞ্জুর করেছে। আগামী সোমবার আদালতে ফের ব্যাখ্যা দেবেন কমিশনের আইনজীবী। এবং সে-দিনই এই মামলায় রায় ঘোষণা করা হতে পারে।
ভোটের প্রচারে মাইক ব্যবহারের অনুমতি সংক্রান্ত নির্দেশিকার উপরে স্থগিতাদেশ জারি করা হবে না কেন, আগের দিন প্রশ্ন তুলেছিল পরিবেশ আদালত। কমিশনের আইনজীবী বিহানি এ দিন আদালতে জানান, ভোটের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, শুধু এমন ক্ষেত্রেই কমিশন হস্তক্ষেপ করতে পারে। মাইক নিয়ে পরিবেশ বিধিতে যা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে ভোটের সরাসরি সম্পর্ক নেই।
কিন্তু কমিশনের এই যুক্তিতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি পরিবেশ আদালত। বিচারপতি রায় বলেন, রাজ্যে বলবৎ থাকা কোনও আইনকে অগ্রাহ্য করা যায় না। এ ক্ষেত্রে বম্বে হাইকোর্টের একটি রায়ের উল্লেখ করেন তিনি। মুম্বইয়ে একটি ভোটের আগে মদ বিক্রির উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু বম্বে হাইকোর্ট জানিয়েছিল, মদ বিক্রি নিয়ে যে-আইন রয়েছে, সেই আইন অগ্রাহ্য করে কমিশনের এই নির্দেশ বৈধ নয়। এ ক্ষেত্রেও মাইক বাজানো নিয়ে আইন অগ্রাহ্য করা হয়েছে বলে মনে করছে পরিবেশ আদালত।
কমিশনের আইনজীবী অবশ্য এই বিষয়টি অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন। বিচারপতি রায় তখন তাঁকে বলেন, ‘‘আমি কিন্তু এ বিষয়ে হোমওয়ার্ক করেই এসেছি।’’
মাইক বাজিয়ে প্রচার রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর সাংবিধানিক অধিকার বলে এর পরে দাবি করেন কমিশনের আইনজীবী। কিন্তু আদালত তাঁকে জানায়, কারও কথা বলার যেমন অধিকার রয়েছে, তেমনই অধিকার রয়েছে না-শোনারও। সেটা মাথায় রাখতে হবে। বিচারপতি রায় জানান, রাজনৈতিক প্রার্থীর কথা বলার মৌলিক অধিকার রয়েছে। কিন্তু মাইকের তো কোনও মৌলিক অধিকার নেই। মাইক বাজিয়ে পরীক্ষার্থীদের বিরক্ত করার বদলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিংবা খালি গলায় মিছিল করেও প্রচার চালানো সম্ভব বলে মনে করে পরিবেশ আদালত।
আবেদনকারী সুভাষবাবু এ দিন আদালতে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং রাজ্যের পরিবেশ দফতরের বিরুদ্ধেও নির্দেশ অমান্য করার অভিযোগ তোলেন। পরিবেশ দফতরের কোনও আইনজীবী এ দিন সওয়াল করেননি। আর পর্ষদের আইনজীবী জানান, বিষয়টি তাঁরা মেনে নিচ্ছেন। তবে এই এক্তিয়ার নিয়ে একটি আইনি জটিলতা আছে।
এই মামলায় আইনি জটিলতার ক্ষেত্রে আদালতকে সাহায্য করার জন্য এ দিন কল্লোল বসু নামে এক আইনজীবীকে ‘আদালত-বান্ধব’ হিসেবে নিয়োগ করেছে ডিভিশন বে়ঞ্চ। কল্লোলবাবু জানান, এখানে প্রশ্নটি সরকার ও কমিশনের এক্তিয়ারের নয়। এটা এক জন নাগরিকের মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন। পরিবেশ আইনকে সংবিধানে আলাদা মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মূলত গুরুত্ব দেওয়া উচিত সেটিকেই। তিনি জানান, ইন্দিরা গাঁধী জরুরি অবস্থা জারি করার পরে সেটা মানুষের সাংবিধানিক অধিকারের বিরোধী বলে মামলা করেছিলেন জবলপুরের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলাশাসক। সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি এইচ আর খন্নার রায়েরও উল্লেখ করেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy