সব্যসাচী দত্ত এবং সায়ন্তন বসু। ফাইল চিত্র।
এ রাজ্যে বিজেপির সবচেয়ে নজরকাড়া প্রার্থীদের অন্যতম ছিলেন তিনি। রাজ্য বিজেপিতে তিনি একেবারে সামনের সারির মুখও। স্বাভাবিক কারণেই তাঁর জয়-পরাজয়ের হিসেব-নিকেশ নিয়ে ভোটবাজারে চর্চা ছিল বিস্তর। সংখ্যালঘু বহুল বসিরহাট লোকসভা আসনে তৃণমূলের নুসরত জাহানকে শেষ পর্যন্ত হারাতে পারেননি সায়ন্তন বসু। কিন্তু দলের লাইনের বিরুদ্ধে কখনও মন্তব্য করতে দেখা যায়নি যাঁকে, নেতৃত্বকে কখনও বিড়ম্বনায় ফেলতে দেখা যায়নি যাঁকে, সেই সায়ন্তন আচমকা বেসুরে বাজতে শুরু করলেন।
শনিবার সকালে সোশ্যাল মিডিয়ায় সায়ন্তন বসুর একটি পোস্ট ঘিরে জোর জল্পনা তৈরি হয়েছে রাজ্য বিজেপির অন্দরে। সেই পোস্টের শুরুর দিকে রাজ্য বিজেপির এই সাধারণ সম্পাদক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন দলের ভাল ফলাফলের জন্য। কিন্তু পরবর্তী অংশে সায়ন্তনের ইঙ্গিত, এ বার বিজেপি ছাড়তে প্রস্তুত তিনি।
ফেসবুক পোস্টে কী লিখেছেন রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক? ‘‘অনেক পুরনো একটা স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে। আগামী বছরের মধ্যে বা তার আগেই আমরা বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার পাব।’’ তিনি আরও লিখেছেন যে, এ রাজ্যে যে দিন বিজেপির সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, সে দিন তিনি খুব খুশি হবেন। কিন্তু তার পরের অংশেই জমে থাকা বারুদের ইঙ্গিত।
সায়ন্তন বসু লিখেছেন, ‘‘আমি গত ১৮ বছর ধরে একজন রাজনৈতিক কর্মী। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও আমাদের গাড়িটা চলছিল না। কিন্তু এখন গাড়িটা পূর্ণ গতিতে ছুটছে। আজ আমি ব্যাটনটা এমন কারও হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত,যিনি শুধু গাড়িটার ভিতরে এসে বসবেন।’’ সায়ন্তনের এই মন্তব্যে কার প্রতি ইঙ্গিত? দলের গাড়ি যখন থমকে ছিল, তখন তিনিই ছিলেন, আজ যখন চাকা গড়াতে শুরু করেছে, তখন অন্য কেউ গাড়িটায় চড়ে বসতে চাইছেন— এমন ইঙ্গিতই যে অত্যন্ত সুকৌশলে সায়ন্তন দিয়েছেন, তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু কথাবার্তায় চৌখস এই বিজেপি মুখপাত্র এমন ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন কথাগুলো যে, ঘরোয়া সমস্যা বা মতানৈক্য প্রকাশ্যে আনার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে কেউ আনতে পারছেন না। কারণ কোথাও কোনও বিষোদ্গার নেই, বিনম্র ভঙ্গিতে নিজেই জায়গা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছেন রাজ্য বিজেপির এই সাধারণ সম্পাদক।
আরও পড়ুন: বহু মুসলিমপ্রধান আসনেও সাফল্য এসেছে বিজেপির, জানেন?
কিন্তু সমস্যাটা কাকে নিয়ে? কাকে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন সায়ন্তন? রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক বললেন, ‘‘এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমে মন্তব্য করতে পারব না। আমার যা জানানোর দলের নেতৃত্বকে জানিয়েছি।’’
সায়ন্তন নিজে মুখ খুলুন বা না খুলুন, সমস্যা যে তৈরি হচ্ছে তাঁর নিজের এলাকা বিধাননগর নিয়েই, সে খবর পাওয়া যাচ্ছে বিজেপির অন্দরে কান পাতলেই। বিধাননগরের মেয়র তথা রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের বিজেপিতে যোগদান আসন্ন বলে মুরলীধর সেন লেন সূত্রের খবর। যদি বিজেপিতে যোগ দেন সব্যসাচী, তা হলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তিনি বিধাননগর থেকে লড়তে চাইবেন বলেও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে ওই আসনের দাবিদার সায়ন্তন বসুও। সঙ্ঘাতের সম্ভাবনা সেখানেই তৈরি হয়েছে বলে খবর।
আরও পড়ুন: বিধানসভাতেও তৃণমূলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস বিজেপির, মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্রেও কোনও রকমে এগিয়ে তৃণমূল
সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে সায়ন্তন বসু বসিরহাট থেকে লড়লেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর এলাকা বিধাননগর যে লোকসভা আসনের অন্তর্গত, সেই বারাসত থেকে লড়তেই সায়ন্তন বেশি আগ্রহী ছিলেন। শেষ মুহূর্তে কোনও এক প্রভাবশালী মহলের অনুরোধে মৃণালকান্তি দেবনাথকে বিজেপি বারাসতের টিকিট দিয়েছিল বলে শোনা যায়। সেই মৃণালকান্তি বারাসতে যে কাকলি ঘোষ দস্তিদারের বিরুদ্ধে তেমন লড়াই দিতে পারেননি, তা গোটা ভোট মরসুম জুড়েই বোঝা গিয়েছে। সায়ন্তন বসু বারাসতের টিকিট পেলে এমনটা হত না বলে তাঁর ঘনিষ্ঠরা মনে করেন। বারাসতের বদলে সংখ্যালঘু প্রধান বসিরহাটে গিয়ে তাঁকে যে ভাবে হেরে ফিরতে হয়েছে, তা নিয়েও সায়ন্তন খুব একটা সন্তুষ্ট নন বলে খবর।
বিধাননগর এলাকার এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘এর পরে বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে হয়তো সায়ন্তনদা-কে বলা হবে, বিধাননগর সব্যসাচীকে ছেড়ে দাও, তুমি রাজারহাট-নিউটাউনে চলে যাও। বিধাননগরে এ বার বিজেপি এগিয়ে রয়েছে। আর সব্যসাচীর আসন রাজারহাট-নিউটাউনে বিজেপি হাজার চব্বিশেক ভোটে পিছিয়ে রয়েছে। কারণ ওই আসন সংখ্যালঘু প্রধান। অর্থাৎ আবার সায়ন্তন বসুকে বসিরহাটের মতো একটা লড়াইয়ে ঠেলে দেওয়া। আমার সঙ্গে এই রকম হলে, আমিও অসন্তুষ্ট হতাম।’’
আরও পড়ুন: ভোটের ফল বেরতেই তাণ্ডব শুরু গোরক্ষকদের, সিওনিতে গাছে বেঁধে পেটানো হল ৩ মুসলিমকে
সায়ন্তন নিজে অবশ্য এ সব প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হচ্ছেন না। তিনি কী কারণে অসন্তুষ্ট, দলের উপরে অসন্তুষ্ট বলেই ওই রকম ফেসবুক পোস্ট কি না, সে সব নিয়ে রাজ্য বিজেপির এই সাধারণ সম্পাদক মুখে কুলুপ এঁটেছেন। ফেসবুক পোস্টটির শেষ অংশে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমার আদর্শগত দায়বদ্ধতাকে আমি বুনিয়াদি এবং সামাজিক উদ্দেশ্য সাধনের কাজে লাগাতে চাইব। আমি সেই প্রেক্ষাপট থেকেই এসেছি। আমার শিকড় রয়েছে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনে।’’ যা সায়ন্তন স্পষ্ট করে লেখেননি, ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন, তা হল— বিজেপিতে আর নয়, আরএসএস-এর কাজে মন দিতে তিনি প্রস্তুত।
সে লক্ষ্যে নিজের মতো করে এগনোর চেষ্টাও ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছেন রাজ্য বিজেপির এই প্রথম সারির মুখ। শুক্রবার রাতে এ রাজ্যের এক শীর্ষ আরএসএস কর্তার সঙ্গে সায়ন্তনের দীর্ঘ কথোপকথন হয়েছে বলে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে। সক্রিয় নির্বাচনী রাজনীতি ছেড়ে সঙ্ঘে ফিরে যাওয়ার যে প্রস্তাব সায়ন্তন রেখেছেন, তাতে ওই আরএসএস নেতা একেবারেই সম্মত হননি বলে খবর। সায়ন্তন বসুকে এখন রাজনৈতিক দায়িত্বই সামলাতে হবে এবং প্রয়োজনে তাঁর উদ্বেগের বিষয়গুলি মিটিয়ে ফেলতে সঙ্ঘ সচেষ্ট হবে— এই বার্তাও তাঁকে দেওয়া হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy