বিজয়ী: জয়ের পর অপরূপা। ছবি: মোহন দাস
গভীর রাতে তাঁর মুখে হাসি ফুটল। কিন্তু তা চওড়া হল না। জয় এল মাত্র ১১৪২ ভোটে!
খাতায়-কলমে আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্রে এ বারও জিতেছেন তৃণমূল প্রার্থী অপরূপা পোদ্দার। কিন্তু এই জয় নিয়ে স্থানীয় তৃণমূলের অন্দরে কোনও উচ্ছ্বাস নেই। নির্বাচন কমিশনের হিসেব বলছে, গোটা রাজ্যে সর্বনিম্ন ব্যবধানে জয় এটাই। এমনকি, আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্রের ভোটের ইতিহাসেও তাই। তৃণমূল প্রার্থী পেয়েছেন ৬ লক্ষ ৪৯ হাজার ৯২৯টি ভোট (৪৪.১৫%)। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি প্রার্থী তপন রায়ের প্রাপ্ত ভোট ৬ লক্ষ ৪৮ হাজার ৭৮৭ (৪৪.০৮%)।
গতবার এই কেন্দ্র থেকেই ৩ লক্ষ ৫১ হাজার ১৩৫ ভোটে জিতেছিলেন অপরূপা। তাঁরই এ বারের ফল নিয়ে তাই আরামবাগ জুড়ে শুরু হয়েছে চর্চা। তাতে হাসি-ঠাট্টাও বাদ যাচ্ছে না। কারণ, আরামবাগের মানুষ লোকসভা ভোটে জয়ী প্রার্থীদের দীর্ঘদিন ধরে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানেই জিততে দেখেছেন। এই শোচনীয় ফল নিয়ে অপরূপার সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘বিষয়টি দল থেকেই সমীক্ষা করা হবে।” গোঘাটের তৃণমূল বিধায়ক মানস মজুমদার বলেন, “সিপিএমের পুরো ভোট বিজেপিতে চলে যাওয়ায় আমাদের এই শোচনীয় হাল। আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতিও হয়তো ছিল। সেগুলো নিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলে শোধরানোর চেষ্টা করতে হবে।”
বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে গণনায় কখনও অপরূপা তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে এগিয়েছেন, কখনও পিছিয়েছেন। দুপুর পেরিয়ে রাতেও গণনাকেন্দ্রে ‘লড়াই’ চলছিল টানটান। রাত ১টা নাগাদ অপরূপাকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। তৃণমূলের একাংশ এমন শোচনীয় ফলের জন্য দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকেও দায়ী করেছেন। এ বার মানুষ যে স্বতঃস্ফূর্ততায় ভোট দিয়েছিলেন, তাতেই প্রমাদ গুনেছিলেন ওই তৃণমূল নেতাদের অনেকে। বিজেপি প্রার্থী তপন রায়ের দাবি, ‘‘এটা বোঝা গেল, আরামবাগের মানুষ এখন বিজেপির উপর ভরসা করতে শুরু করেছেন। আগামী দিনে লড়াইয়ে সেটাই আমাদের প্রেরণা।’’
অবশ্য ভোট গণনায় গোলমাল করা হয়েছে বলে অভিযোগও তুলেছে বিজেপি। দলের জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য মুকুল রায় এবং তপনবাবু শুক্রবার মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দফতরে গিয়ে ওই অভিযোগ জানান। পরে মুকুলবাবু বলেন, ‘‘আরামবাগে ৪৫টা ইভিএম গোনাই হয়নি। কেবল ওগুলোর ভিভিপ্যাট গুনে ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এটা অন্যায়। ভিভিপ্যাট ইভিএমের বিকল্প নয়।’’ তাঁরা কী ভাবে এর বিহিত চাইবেন? মুকুলবাবু বলেন, ‘‘মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দফতর থেকে বলা হয়েছে, তাদের হাতে কিছু নেই। সব পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে দিল্লিতে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের দফতরে। আমরা সেখানেও দরবার করব। আইনের দরজাতেও যাব।’’
এই আরামবাগ কেন্দ্র থেকেই ২০০৪ সালের নির্বাচনে সিপিএমের প্রয়াত অনিল বসু প্রায় ৬ লক্ষ ভোটের ব্যবধানে জিতে গোটা দেশে রেকর্ড করেছিলেন। সেই রেকর্ড এখনও অটুট। ইতিহাসও বলছে, ১৯৬৭ সাল থেকে আরামবাগ লোকসভা আসনে (তার আগে এই কেন্দ্রটি ছিল বর্ধমান লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত) ভোট শুরু হওয়া ইস্তক একবারই জয়ী প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান চোখে পড়ার মতো কমেছিল। সেটা ১৯৮৪ সালে। সিপিএমের অনিল বসুই মাত্র ১৪ হাজার ১৬০ ভোটে হারিয়েছিলেন কংগ্রেসের গোপাল দাস নাগকে। এ বার অপরূপা সেই ‘রেকর্ড’ও ভাঙলেন!
এই চর্চা করতে করতেই শুক্রবার শহরের হাসপাতাল মোড়ের একটি চায়ের দোকানে এসে গোঘাটের এক প্রৌঢ়ের বক্রোক্তি, ‘‘যে আরামবাগে লাখের নীচে গল্প নেই, সেখানে ১১৪২টি ভোট জেতা সাংসদকে তো কেউ আর অনুষ্ঠান উদ্বোধনেও ডাকবেন না!” কোথাও আবার আরামবাগের রাজনৈতিক চরিত্র বদল নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনাও হতে দেখা গিয়েছে।
তাদের পুরনো ‘গড়’ আরামবাগে সিপিএমের রক্তক্ষরণ অবশ্য অব্যাহত। সিপিএম প্রার্থী শক্তিমোহন মালিক পেয়েছেন ১ লক্ষ ৫২০ ভোট (৬.৮৩%)। তাদের ভোট কি বিজেপিতে গিয়েছে? সরাসরি উত্তর না দিয়ে আরামবাগের সিপিএম নেতা তথা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “মানুষ কারও দাস নন। স্বাধীন ভাবে ভোট দিয়েছেন। তাঁরা হয়তো ভেবেছেন আমাদের দ্বারা তৃণমূলের সন্ত্রাস প্রতিরোধ সম্ভব হবে না। তাই মানুষ চুপচাপ ওলোট-পালোট করে দিয়েছেন।”
কংগ্রেস থেমে গিয়েছে মাত্র ১.৭১% ভোটে। তাদের প্রার্থী জ্যোতিকুমারী দাসের প্রাপ্ত ভোট মাত্র ২৫ হাজার ১২৮।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy