সকাল ১১টায় সাগরে কপিলমুনির মন্দির। চোখে পড়ল না থার্মাল চেকিংয়ের ব্যবস্থা। ছবি: সমরেশ মণ্ডল
প্রবেশের ছাড়পত্র পেতে টিকার দু’টি ডোজ় থাকতেই হবে। সঙ্গে বাধ্য়তামূলক শেষ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে করানো আরটি-পিসিআরের নেগেটিভ রিপোর্ট। আগুনে গতিতে সংক্রমণ ছড়ানোর এই সময়ে গঙ্গাসাগর মেলাকে যথাসম্ভব নিরাপদ করতে মঙ্গলবার এই দুই কড়া শর্ত জুড়ে দিল কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব এবং বিচারপতি কেসাং ডোমা ভুটিয়ার ডিভিশন বেঞ্চ। গড়ে দিল নতুন দুই সদস্যের নজরদার কমিটি। আদালতের নির্দেশ মেনে মেলা না হলে, তা বন্ধ করার এক্তিয়ারও দেওয়া রইল তার হাতে। কিন্তু এই সমস্ত কিছুর পরেও রাজনৈতিক, চিকিৎসক ও পর্যবেক্ষক মহলে প্রশ্ন, মেলার বিপুল সমাগমে নির্দেশ কার্যকর করা আদৌ সম্ভব হবে তো? যেখানে প্রায় পাঁচ লক্ষ পুণ্যার্থী আসার কথা, সেখানে কে, কী ভাবে খতিয়ে দেখবেন এত জনের টিকার শংসাপত্র কিংবা পরীক্ষার রিপোর্ট? মাস্ক পরা কিংবা দূরত্ব-বিধি বজায় রাখার নিয়মই বা মানা হবে কতখানি? অনেকের আশা, কোভিড-সঙ্কট মাথায় রেখে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার কথা ভাববে আদালত।
রাজনীতির পরিসর সরগরম কমিটি থেকে বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর নাম বাদ পড়া নিয়েও। কোভিড-বিধি মেনে এ বারের গঙ্গাসাগর মেলা আয়োজনের বিষয়ে নজরদারির জন্য গত সপ্তাহে শুভেন্দু-সহ তিন সদস্যের একটি নজরদার কমিটি গড়েছিল আদালত। এ দিন সেই পুরনো রায় বদল করে জানানো হয়েছে, কোর্টের তরফে দু’সদস্যের কমিটি থাকবে। চেয়ারপার্সন হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সমাপ্তি চট্টোপাধ্যায় এবং অপর জন রাজ্য লিগ্যাল এড সার্ভিসের সদস্য-সচিব। এ প্রসঙ্গে রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, ‘‘দেশে বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতা এক সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেন। তাই আদালতের এ দিনের রায় অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।’’ তাঁর বক্তব্য, গণতন্ত্রে বিরোধীর ভূমিকা শাসকের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিরোধীর সাংবিধানিক ভূমিকা রাজ্য কোর্টে মানতে নারাজ। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আদালতও সেই যুক্তি মেনে নিয়েছে।
আদালতের নির্দেশ, শুধু কপিল মুনির আশ্রম চত্বর নয়, পুরো সাগরদ্বীপকে মেলার নোটিফায়েড এলাকা বলে চিহ্নিত করতে হবে। রায় ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে। নির্দেশিকা মেনে মেলা আয়োজনে রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ব্যক্তিগত ভাবে দায়বদ্ধ করেছে হাই কোর্ট।
কিন্তু চিকিৎসক মহল থেকে আমজনতা— সকলের মনে সংশয়ের মেঘ জমা থাকছে এর পরেও। আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েও প্রশ্ন উঠছে, বাস্তবে তা কতটা পালন করা সম্ভব? রাজ্যের হিসাবে, এ বছর মেলায় পাঁচ লক্ষ লোকের জমায়েত হবে। স্বভাবতই প্রশ্ন, এত জনের টিকার শংসাপত্র, আরটি-পিসিআর রিপোর্ট খতিয়ে দেখার মতো পরিকাঠামো আদৌ রয়েছে? এত কম সময়ে কত জনের করোনা-পরীক্ষা করা ও তার রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব, যেখানে বিমানবন্দরের মতো নিয়ন্ত্রিত এলাকায়, তুলনায় অনেক কম মানুষের ক্ষেত্রে তা করতেই হিমশিম খেতে হয়? ইতিমধ্যে যাঁরা সাগরদ্বীপে পৌঁছে গিয়েছেন, তাঁদেরই বা কী হবে?
চিকিৎসক সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের তরফে কৌশিক লাহিড়ীর বক্তব্য, রাজ্য যে জমায়েত বন্ধের নির্দেশিকা জারি করেছে, তা-ই তো মানা হচ্ছে না। বলা হয়েছিল, ৫০ জনের বেশি জমায়েত করা যাবে না। মেলা প্রাঙ্গণে ইতিমধ্যেই ৫০ হাজার লোক ভিড় করেছেন। এ বার ৫ লক্ষ পুণ্যার্থী এবং ১০ হাজার পুলিশকর্মীর ভিড়ে কী ভাবে বিধি পালন সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। তাঁর কথায়, “আদালতের উপরে আস্থা আছে। সব দিক ভেবে খুব দেরি হওয়ার আগে কোর্ট নিশ্চয় কোনও ব্যবস্থা নেবে।”
শমীকের মতেও, সরকার যে ভাবে ভিড় নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে, তা বাস্তবে অসম্ভব। হাই কোর্টের নির্দেশকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়েও তাঁর আশা, কোর্ট নিশ্চয়ই পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে। তিনি বলেন, ‘‘কোর্টে শুনানি হচ্ছে ভার্চুয়ালি, সেখানে মেলা ফিজ়িক্যালি হবে? আমরা চাই, পুজো হোক, কিন্তু মেলা বন্ধ থাকুক।’’
কংগ্রেস নেতা অধীররঞ্জন চৌধুরীর কথায়, “এই মেলা শেষে সংক্রমণ মেলায় রূপান্তরিত হলে, তা আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। চিকিৎসক থেকে নার্স— সবাই সংক্রমিত হচ্ছেন।... এক জন জনপ্রতিনিধি হিসেবে চাইছি না যে, এই মেলা হোক।”
রাজ্য সরকারের শীর্ষ মহলের একাংশ মানছে, ভিন্ রাজ্য থেকে আসা পুণ্যার্থী বোঝাই বাসে নিয়ন্ত্রণ থাকলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুবিধা হত। কিন্তু কী ভাবে, সেই উত্তর এখনও পর্যন্ত অধরা। কারণ হিসেবে শীর্ষ মহলের বক্তব্য, সীমানায় বাস আটকালে, অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। অভিযোগ উঠতে পারে ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপের।
মেলার সময়ে ফি বছর কাকদ্বীপ, নামখানার জেটিগুলিতে ভিড় উপচে পড়ে। বাবুঘাটের অস্থায়ী ক্যাম্প, সাগরমুখী বাস থেকে সেখানকার ভেসেল— সর্বত্র চোখে পড়ে ঠাসাঠাসি ভিড়। প্রশ্ন, এ বছরে তুলনায় লোক কিছুটা কম আসবে ধরেও কি এত জনের উপরে নজরদারি সম্ভব?
আদালত জানিয়েছে, নির্দেশিকা না-মানলে, নজরদার কমিটি মেলা বন্ধের নির্দেশ দিতে পারে। কিন্তু বহু লক্ষের সমাগমের পরে আচমকা মেলা বন্ধ করা কতটা সম্ভব, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে জনমানসে। অনেকে এ-ও বলছেন, যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে মেলায় যাওয়া পুণ্যার্থীদের ২০ শতাংশও যদি সংক্রমিত হন, তা হলে প্রায় ১ লক্ষ জন আক্রান্ত হবেন। তখন তাঁদের কোথায় রাখা হবে? এঁদের ১০ শতাংশের অবস্থা গুরুতর হলে, হাসপাতালে ১০ হাজার কোভিড শয্যা প্রয়োজন। সেই পরিকাঠামো সাগরে বা কাকদ্বীপে নেই বলেও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত।
উল্লেখ্য, রাজ্যে বর্তমান কোভিড পরিস্থিতি মাথায় রেখে গঙ্গাসাগর মেলা এ বছরের জন্য বন্ধের আর্জি জানিয়ে হাই কোর্টে মামলা করেছিলেন অভিনন্দন মণ্ডল নামে এক চিকিৎসক। পরে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম তাতে যুক্ত হয়। ওই মামলায় রায়ের পরে তাতে সংশোধনী চেয়ে ফের মামলা হয়। যুক্ত হন কয়েক জন সমাজকর্মী। প্রথমে আদালত বিরোধী দলনেতা, রাজ্য মানবাধিকার কমিশন এবং রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিকে নিয়ে নজরদার কমিটি করেছিল। মামলাকারীদের আর্জি ছিল, কমিটিতে চিকিৎসকদের থাকা উচিত। রাজ্যের তরফেও বিরোধী দলনেতাকে রাখা নিয়ে আপত্তি করা হয়। রাজ্যের কৌঁসুলির যুক্তি ছিল, বিরোধী দলনেতা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁকে এই কমিটিতে রাখা অযৌক্তিক। সেই সূত্রেই এ দিনের নির্দেশ। এ দিন নতুন কমিটিতে বিরোধী দলনেতা বা রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি নেই। তেমনই ঠাঁই পাননি কোনও চিকিৎসক বা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy