অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ
গায়ে ধুম জ্বর, ঘন ঘন বমি হচ্ছে। মূত্রনালির সংক্রমণে মরণাপন্ন বাবা। তাঁকে নিয়ে রাতভর কলকাতার বেশ কয়েকটি নামী বেসরকারি হাসপাতালে ছুটে বেড়ালেন রাজ্য পুলিশের এক সাব ইন্সপেক্টর। কিন্তু, কোথাও ভর্তি করাতে পারেননি বলে অভিযোগ।
সব জায়গাতেই প্রথমে বলা হয়, বেড আছে। কিন্তু রোগীর সরকারি স্বাস্থ্য প্রকল্পের আওতায় ক্যাশলেস চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে শুনেই বলে দেওয়া হয়, বেড নেই। অভিযোগ, কোনও কারণ ছাড়াই মুমুর্ষু ওই রোগীকে ভর্তি নিতে অস্বীকার করে হাসপাতালগুলি। মোট চারটি বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে ওই সাব ইন্সপেক্টরের বাবাকে ভর্তি না নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সোমবার রাতভর দৌড়ঝাঁপের পর মঙ্গলবার সকালে এনআরএস হাসপাতালে বাবাকে ভর্তি করিয়েছেন সাব ইন্সপেক্টর তাপস ঘোষ।
বেসরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে চিকিৎসাকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তা রুখতে একাধিক কড়া পদক্ষেপ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু হাসপাতালগুলি মুখে যাই বলুক, কাজে যে তারা একটুও বদলাতে রাজি নয়, সোমবার রাতের ঘটনায় ফের তা পরিষ্কার। রাজ্য সরকারের হেল্থ স্কিমে ক্যাশলেস চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার কথা এই হাসপাতালগুলির। কারণ, চারটি হাসপাতালই সরকারি এই পরিষেবার তালিকাভুক্ত। কিন্তু তার পরেও রোগীকে প্রত্যাখ্যানের অভিযোগ উঠল ডিসান, মেডিকা ও ফর্টিস (এই সংস্থার দু’টি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ) হাসপাতালের বিরুদ্ধে। ভর্তি করার কথা বলেও সরকারি স্বাস্থ্যবিমার কথা শুনেই ফিরিয়ে দেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, তা আরও গুরুতর।
এ দিন মেডিকা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, অন্য হাসপাতালের কথা তিনি বলতে পারবেন না। তবে তাঁরা কোনও রোগীকে ফেরান না। এ রকম কিছু হলে, নিতান্তই বেড না থাকার কারণেই হয়ে থাকতে পারে। অন্য দুই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ‘ডিসান’ ও ‘ফর্টিস’ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি।
আরও পড়ুন: বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি করেছে ফেসবুক! অর্ধেক অ্যাকাউন্টই ভুয়ো, দাবি মার্কের বন্ধুর
ঠিক কী হয়েছিল? সাব ইন্সপেক্টর তাপস ঘোষ উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁ থানায় কর্মরত। বাড়ি নবদ্বীপে। তাঁর বাবা মধু ঘোষ মূত্রনালির সংক্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়ায় প্রথমে নবদ্বীপ হাসপাতালে ভর্তি করেন পরিবারের লোকজন। সোমবার ওই হাসপাতাল থেকে তাঁকে কলকাতায় রেফার করা হয়। রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ মধুবাবুকে নিয়ে কলকাতায় রওনা দেন পরিবারের লোকজন। রাত একটা নাগাদ কলকাতায়পৌঁছে তাঁরা প্রথমে যান বাইপাসের ধারে ফর্টিস হাসপাতালে। তাপসবাবুর অভিযোগ, ‘‘প্রথমে কিছুই বলা হয়নি। কিন্তু সরকারি স্বাস্থ্যবিমার কথা বলতেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, বেড নেই।’’ তবে ওই হাসপাতালেরই রাসবিহারী শাখায় ভর্তি হতে পারে বলে জানানো হয় তাপসবাবুদের।
ওই রাতেই তড়িঘড়ি তাঁরা ছোটেন রাসবিহারীতে। কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা। ক্যাশলেসের কথা জানার পর বেড নেই বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তাপসবাবু বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে কলকাতার আনন্দপুর থানায় কর্মরত এক পুলিশ অফিসারকে ফোন করি। কয়েকটি হাসপাতালে কথা বলার পর তিনি ডিসান হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেই মতো আবার রাসবিহারী থেকে ছুটে যাই ডিসানে।’’
আরও পড়ুন: আরামবাগ থেকে ধৃত খাগড়াগড় কাণ্ডে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ দুই জঙ্গি
তাপসবাবু বলেন, ‘‘ডিসানের অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ।’’ তিনি জানান, সেখানে প্রথমে এমার্জেন্সিতে ভর্তি নেয় কর্তৃপক্ষ। রাত তখন প্রায় সাড়ে তিনটে। কিন্তু, ক্যাশলেসের কথা শুনেই বেঁকে বসে এই হাসপাতালও। প্রথমে বলা হয়, কয়েক দিন ধরে রাজ্য সরকারের হেল্থ স্কিমে ক্যাশলেসে কিছু সমস্যা হচ্ছে। তাই নগদে চিকিৎসা করতে হবে। তাপসবাবু বলেন, ‘‘বাবার কথা ভেবে তাতেই রাজি হয়ে যাই। তখন তাঁরা একটি ফর্ম দেন। যেটি আসলে একটি বন্ড। যাতে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হয়, ক্যাশলেস চিকিৎসার আওতায় হলেও আমি নগদে চিকিৎসা করাব। তাতেই সই করে দিই। কিন্তু তার পরও কিছুক্ষণ টালবাহানার পর হাসপাতালের কর্মীরা জানিয়ে দেন, নগদেও চিকিৎসা করতে পারবেন না তাঁরা। স্পষ্ট কারণও বলেনি তাঁরা।’’ তাপসবাবুর আরও অভিযোগ, ‘‘এমার্জেন্সিতে কার্যত বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা হয়েছিল দু’ঘণ্টা। সামান্য জ্বরের ওষুধ ছাড়া কিছুই দেওয়া হয়নি।’’
তাপসবাবুর পরের পরীক্ষা ছিল মেডিকা হাসপাতালে। বাবাকে ডিসানে রেখেই ছোটেন মেডিকা হাসপাতালে। তাপসবাবুর দাবি, সেখানেও কম বেশি একই অভিজ্ঞতা। প্রথমে সব কিছু জানার পর চিকিৎসায় রাজি হলেও ক্যাশলেস শোনার পরই প্রত্যাখ্যান করা হয়। আবার ফর্টিস হাসপাতালেও যান তাপসবাবু, কিন্তু কর্তৃপক্ষের উত্তর ছিল একই। তিনি বলেন, ‘‘এ ভাবে চলতে চলতে সকাল হয়ে যায়। তার পর বাধ্য হয়ে এনআরএস হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে বাবাকে ভর্তি করি। সেখানে আপাতত চিকিৎসা শুরু হয়েছে।’’
তাপসবাবু সরকারি কর্মী। রাজ্য সরকারের হেল্থ স্কিমে তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালে ক্যাশলেস চিকিৎসা পাওয়ার কথা তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘এই হেল্থ স্কিমের জন্য প্রতি মাসে আমাদের মাইনে থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা কেটে নেওয়া হয়। অথচ এই বেসরকারি হাসপাতালগুলি এ ভাবে মুমুর্ষু মানুষকে হয়রান করছে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে।’’
(দুই চব্বিশ পরগনা, হাওড়া ও হুগলি, নদিয়া-মুর্শিদাবাদ, সহ দক্ষিণবঙ্গের খবর, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা খবর, বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের খবর পেয়ে জান আমাদের রাজ্য বিভাগে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy