বিশ্বকাপ ফাইনালে পেনাল্টিতে ৩-৩ করার পর এমবাপে। ছবি: রয়টার্স।
পেনাল্টি থেকে মেসি প্রথম গোলটা দিতেই চিৎকারটা থেমে গিয়েছিল। ৩৬ মিনিটের মাথায় দি মারিয়া দ্বিতীয় গোল দিতেই সবাই চুপ!
কে বলবে এই পানশালা সন্ধ্যা থেকেই ফ্রান্সের জন্য গলা ফাটাচ্ছিল। কেউ কেউ ফরাসি ভাষায় চিৎকার করছিলেন, ‘নুজ্যালঁ গাঁইয়ে’ (আমরাই জিতব), ‘ম্যাতনঁ ক্যুপ দ্য মন্দ এ নত্র’ (এ বার বিশ্বকাপ আমাদের) ‘এমবাপে ভু জ্যাত নত্র এরো’ (এমবাপে আমাদের নায়ক)। সেই ‘নায়ক’ হ্যাট্রিক করতেই বদলে গেল স্লোগান। চিৎকার করে গৌতম সাহা বলছিলেন, ‘‘এমবাপে ভু জ্যাত নত্র দিউ’ (এমবাপে আমাদের ভগবান)!
টান টান খেলায় পারদ ওঠানামা করছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরটায়। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। তবে মেসিদের হাতে কাপ উঠতেও গৌতম স্লোগান বদলালেন না। বললেন, ‘‘হ্যাট্রিক আর টাইব্রেকারে গোল দিয়ে এমবাপে কিন্তু নায়কই থেকে গেলেন।’’
পিছিয়ে থেকেও বার বার প্রিয় দল ফ্রান্সের সমতা আনার উত্তেজনায় পানের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল সৌরভ দত্তেরও। কানাইলাল বিদ্যামন্দিরের ফরাসি বিভাগের প্রাক্তন সৌরভ স্কুলে শেখা ভাষাতেই বলছিলেন, ‘‘লা শঁস নেতে পা আভেক নু।’’ (ভাগ্য আমাদের সঙ্গে ছিল না।) সেটা শুনে আবার আর্জেন্টিনার সমর্থক সমর গায়েন টেনিদার ভঙ্গিতে শুনিয়ে দিলেন, ‘ডি ল্যা গ্রান্ডি মেফিস্টো নয়, মেসিস্টোফিলিস, ইয়াক ইয়াক!’’
ফরাসি জমানার পানশালা ‘রেস্তরাঁ দে চন্দননগর’-এ তখন মেসি সমর্থকদের উল্লাসে কান পাতা দায়। তার মধ্যেও ফ্রান্স সমর্থকরা ‘নায়ক’ এমবাপের নামে জয়ধ্বনি দিয়েই গেলেন। যুক্তি, আর্জেন্টিনা জিতলেও ফাইনালে মেসিকে হারিয়ে দিয়েছেন এমবাপে!
চন্দননগরে ফ্রান্সকে নিয়ে উত্তেজনা প্রথম টের পাওয়া গিয়েছিল গত বিশ্বকাপে। ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দে অনন্য হয়েছিল অতীত বাংলার এই ফরাসি উপনিবেশ। কিন্তু কেন ফ্রান্সের প্রতি এত টান?
রবিবার বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন সন্ধে নামার আগেই হাজির হয়েছিলাম চন্দননগর স্ট্র্যান্ডে। গোটা এলাকাটাই ফরাসি উপনিবেশের নিদর্শনে ভরা। সুন্দর বাঁধানো গঙ্গার পাড়। রাস্তা পার হলেই কলেজ দুপ্লে (এখন চন্দননগর সরকারি কলেজ), দুপ্লে প্যালেস (এখন চন্দননগর মিউজিয়াম)। পাশেই রবীন্দ্রভবন। তার সামনে চন্দননগর পুরসভা বড় স্ক্রিনে বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখার ব্যবস্থা করেছে। খেলা দেখার মেলা বসে গিয়েছে।
চন্দননগর মানে অবশ্য সবাই ফ্রান্সের সমর্থক নন। অনেকে আর্জেন্টিনা, সর্বোপরি মেসির ভক্ত। গোলমাল না বাধে! কড়া পাহারা পুলিশের। যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ। হেঁটেই যেতে হল রবীন্দ্র ভবন পর্যন্ত। ব্যারিকেডের এ পারটা ফ্রান্স আর ও পাশটা আর্জেন্টিনা। যেন দুই দেশের সীমান্ত গড়েছে পুলিশ। নীল-সাদার থেকে অবশ্য লাল-নীল-সাদা পতাকাই বেশি। কিন্তু সেই পতাকা লাগানোর উৎসাহ উধাও করে দিল টাইব্রেকার। প্রথম থেকেই খেলায় আর্জেন্টিনার দাপট ছিল। কিন্তু শেষটা যে একেবারে এই ভাবে ‘নায়ক’ এমবাপে ফাইনাল জমিয়ে দেবেন, ভাবতেই পারেননি অনেকে।
পেশায় তবলাবাদক হলেও শুভেন্দু কর্মকারের নেশা চন্দননগরের অতীতের খোঁজ রাখা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন অতীতের ফরাসডাঙা। বললেন, ‘‘এই শহরের সবটাই কিন্তু ফরাসডাঙা নয়। সেটা একটা বিশেষ এলাকা। ফরাসি সন্তরা থাকতেন বলে ওই এলাকাটার নাম পাদ্রিপাড়া।’’ শুভেন্দুর সঙ্গে পাদ্রিপাড়ায় গিয়ে দেখা গেল সেখানে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টানদের মিলিত বাস। মসজিদের পাশেই হয় জগদ্ধাত্রী পুজো। আবার একেবারে কাছে ফরাসি আমলে তৈরি সেক্রেড হার্ট গির্জা। শুভেন্দু ইতিহাসও শোনালেন, ‘‘ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও এই শহর ফরাসিদের হাতে ছিল। ১৯৫০ সালে ভারত সরকারের হাতে চন্দননগর অর্পণ করা হয়।’’ পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গ হতে তো আরও কিছুটা সময় লেগেছিল? শুভেন্দু বললেন, ‘‘সেই সময়ে ভোটাভুটি করে ঠিক হয়েছিল চন্দননগর রাজ্যে ঢুকবে না কি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয়ে থাকবে। পরে ‘চন্দননগর মার্জার অ্যাক্ট ১৯৫৪’ জারি হয়েছিল।’’
জগদ্ধাত্রী পুজো থেকে ফুটবলপ্রেম— সবেতেই চন্দননগর নিয়ে গর্ব করতে ভালবাসেন বাবু পাল। আদ্যোপান্ত ফ্রান্সের সমর্থক। ম্যাচ শুরুর আগেই বলছিলেন, ‘‘আসলে চন্দননগরে শাসন করলেও আমাদের ফ্রান্সের উপরে কোনও রাগ নেই। কলেজ থেকে চার্চ অনেক কিছু করে গিয়েছে ওরা। ফরাসি গভর্নর মঁসিয়ে ডুপ্লের আমলে বদলে যায় চন্দননগর।’’ এই শহরের নামও ফরাসিদের উচ্চারণ থেকেই এসেছে বলে দাবি বাবুর। বলেন, ‘‘কলকাতার মতো এই শহরও তিনটি গ্রাম নিয়ে তৈরি হয়— গোন্দলপাড়া, খলিসানি এবং বোড়ো কিষেণপুর। তৃতীয় জায়গাটার প্রধান দেবী চণ্ডী। এখনও বোড়াই চণ্ডীর মন্দির রয়েছে। সেই থেকেই শহরের নামটা ‘চণ্ডীরনগর’ ছিল। কিন্তু ফরাসিরা উচ্চারণ করতেন ‘চাণ্ডেরনাগোর’। সেটাই বদলাতে বদলাতে ‘চন্দননগর’ হয়েছে।’’
ফরাসি চন্দননগর নিয়ে গল্পের শেষ নেই। এখনও এই শহরে ফরাসি ভাষার শিক্ষা রয়ে গিয়েছে। আনন্দময়ীতলার বাসিন্দা রুমা দে বাড়িতে ফরাসি পড়ান। তিনিই বললেন, ‘‘এখন সংখ্যাটা কমে গেলেও অনেকেই কিন্তু ফরাসি পড়ে। কানাইলাল বিদ্যামন্দিরের আলাদা শাখা তো রয়েইছে। সেই সঙ্গে অনেক স্কুলেই সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে তৃতীয় ভাষা এবং একাদশ-দ্বাদশে অতিরিক্ত বিষয় হিসাবে ফরাসি নেওয়া যায়। চন্দননগর কলেজে তো ফরাসি বিভাগও রয়েছে।’’ ফরাসি সরকার এখনও এই শহরের জন্য ‘সার্টিফিকা’ পরীক্ষা নিয়ে থাকে।
সেই পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন পানশালায় আলাপ হওয়া গৌতম। যিনি বললেন, ‘‘ফ্রান্স জিতলে ফ্যাস্তা দেখতে পেতেন। সেটা হল না। সব কিছুই তৈরি ছিল।’’ সেটা কী? গৌতম জানালেন, ‘‘এক সময়ে এই শহরের বার্ষিক উৎসব ছিল ‘ফ্যাস্তা’। প্রতি বছর ১৪ জুলাই ফ্রান্সের জাতীয় দিবসে ফুল দিয়ে সাজানো হত শহর। মশাল নিয়ে শোভাযাত্রা হত। চ্যাম্পিয়ান হলে অকাল ফ্যাস্তার পরিকল্পনা ছিল। হল না।’’
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সমর তখনও ফরাসিতেই বিড়বিড় করছেন। বললেন, ‘‘লা শঁস নেতে পা আভেক নু। প্লু দ্য শঁস লা প্রশেন ফোয়া৷’’ একই কথা বাংলাতেও বললেন, ‘‘ভাগ্য আমাদের সঙ্গে ছিল না। পরের বার ঠিক আমাদের ভাগ্য সঙ্গ দেবে।’’
পরের বারের অপেক্ষায় থাকা আলোর শহর চন্দননগর থুড়ি ফরাসডাঙাকে একলা রেখে ফিরতি পথে দেখি, মিছিল বের করেছেন একই শহরের অন্য পড়শিরা। স্লোগান উঠছে, ‘‘মেসি-মেসি-মেসি...!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy