Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
শিকড় ছত্তীসগঢ়

মাওবাদী মেয়ে বাহিনীও কি রাজ্যে

বাঙালি মেয়েদের থেকে অনেক বেশি কষ্ট সইতে পারেন তাঁরা। জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে ছিটেফোঁটা জল ও খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে পারেন দিনের পর দিন। অবলীলায় হাতে ধরতে পারেন বিষাক্ত সাপ। এঁরা অনেকেই ‘শার্প শ্যুটার’। স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর পাশাপাশি গ্রেনেড ছোড়া কিংবা ছুরি নিয়ে মুখোমুখি লড়াইয়েও পটু।

তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২০
Share: Save:

বাঙালি মেয়েদের থেকে অনেক বেশি কষ্ট সইতে পারেন তাঁরা। জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে ছিটেফোঁটা জল ও খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে পারেন দিনের পর দিন। অবলীলায় হাতে ধরতে পারেন বিষাক্ত সাপ। এঁরা অনেকেই ‘শার্প শ্যুটার’। স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর পাশাপাশি গ্রেনেড ছোড়া কিংবা ছুরি নিয়ে মুখোমুখি লড়াইয়েও পটু।

সিপিআই (মাওবাদী)-র ‘মিলিটারি কলাম’-এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এই প্রমীলা বাহিনী। স্বাধীনতা দিবসের আগে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে ঢুকে নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে বড় ধরনের নাশকতা
চালাতে মাওবাদীরা ৬০ জনের একটি বিশেষ স্কোয়াড তৈরি করেছে বলে গোয়েন্দা সূত্রের খবর। অনুমান করা হচ্ছে, সেই স্কোয়াডে থাকতে পারেন জঙ্গলযুদ্ধে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এমনই ১৫-২০ জন মহিলা। যাঁদের অধিকাংশকেই সম্ভবত পাঠানো হচ্ছে ছত্তীসগঢ় থেকে।

জঙ্গলমহলে নতুন করে মাওবাদী হানা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সতর্কবার্তা নবান্নে এসে পৌঁছনোর পর তোলপাড় পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ-প্রশাসনে। নড়ে বসেছে ছত্তীসগঢ় পুলিশও। বিশেষ করে প্রমীলা-বাহিনীর উপস্থিতির কথা ভেবে গোয়েন্দাকর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও বেড়েছে। ২০১০-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম মেদিনীপুরের শিলদায় ইএফআর ক্যাম্পে মাওবাদী হানায় প্রাণ গিয়েছিল ২৪ জন জওয়ানের। তদন্তে উঠে আসে, হামলার আগে ছদ্মবেশে শিলদা ক্যাম্পে রেকি করে গিয়েছিল মহিলা মাওবাদীদের একটি দল।

শিলদার ঘটনার ঠিক দু’মাসের মধ্যে ছত্তীসগঢ়ের দন্তেওয়াড়ায়— টারমেটলার জঙ্গলে মাওবাদী হামলায় নিহত হয়েছিলেন ৭৬ জন সিআরপি জওয়ান। সেই হামলাতেও জড়িত ছিলেন বেশ কয়েক জন মহিলা ক্যাডার। ২০১০-এর ৬ এপ্রিলের ওই হামলার পিছনে যাঁর মস্তিষ্ক ছিল, মাওবাদী কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সেই রামান্নাই এ বার পশ্চিমবঙ্গে মহিলা ক্যাডার পাঠানোর পরিকল্পনা করেছেন বলে গোয়েন্দাদের একাংশের সন্দেহ।

কিন্তু মাওবাদী স্কোয়াডে মহিলা সদস্য তো সব রাজ্যেই আছে। ছত্তীসগঢ় নিয়ে আলাদা চিন্তা কেন?

উত্তরে একটা তারিখ মনে করিয়ে দিচ্ছেন গোয়েন্দাকর্তারা— ২৫ মে, ২০১৩। ওই দিন ছত্তীসগঢ়ের বস্তারের দরভা-য় প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের কনভয়ে হামলা চালিয়েছিল মাওবাদীরা। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ছত্তীসগঢ় বিধানসভার প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা মহেন্দ্র কর্মা, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্ল, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নন্দকুমার পটেল, তাঁর ছেলে দীনেশ, বিধায়ক, প্রাক্তন বিধায়ক-সহ দলীয় নেতা-কর্মী-দেহরক্ষী মিলিয়ে ৩০ জন। কার্যত ছত্তীসগঢ়ের গোটা প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বকে মুছে দিয়েছিল ওই একটি হামলা। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, সেই অভিযান চালিয়েছিল মাওবাদীদের কেরলাপাল এরিয়া কমিটি এবং দরভা ডিভিশনাল কমিটি। এই অভিযানে একে-৪৭ এবং হাল্কা মেশিনগান নিয়ে একেবারে সামনের সারিতে ছিলেন বেশ কয়েক জন তরুণী।

দরভার হামলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া ওই প্রমীলা বাহিনীতে এখন কিছু নতুন মুখকেও আনা হয়েছে বলে খবর। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে হামলার জন্য গঠিত স্কোয়াডে এই বাহিনীরই বাছাই করা বেশ কয়েক জনের থাকার সম্ভাবনা তাই উড়িয়ে দিচ্ছেন না গোয়েন্দারা। ছত্তীসগঢ় পুলিশের আইজি (এসআইবি) দীপাংশু কাবরা আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘চট করে বলা মুশকিল, কোন স্কোয়াডের মেয়েরা কোথায় গিয়ে কাজ করবে। বস্তারের দরভা বা ওড়িশার মালকানগিরির স্কোয়াডের মেয়েরা আগে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে কাজ করেনি বটে। কিন্তু এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না যে, তারা সেখানে আদৌ যাবে না।’’ তাঁর বিশ্লেষণ, পুলিশ-আধাসেনাকে চমকে দিতে একেবারে নতুন মুখ কাজে লাগাতেই পারে মাওবাদীরা। এ ব্যাপারে আরও জানতে আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের সঙ্গে কথা বলবেন গোয়েন্দারা।

আসলে পুলিশের দুশ্চিন্তার কারণ একাধিক। প্রথমত, আটপৌরে শাড়িতে ছদ্মবেশ ধরে মহিলা মাওবাদীরা খুব সহজেই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গ্রামে ঢুকে যেতে পারেন। কোনও বাড়িতে আত্মীয় সেজে দীর্ঘদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারেন তাঁরা। দ্বিতীয়ত, শহুরে এলাকাতেও সহজে মিশে যেতে পারেন এঁরা। তৃতীয়ত, মাওবাদী স্কোয়াডে নতুন ‘রিক্রুট’দের ছবি চট করে গোয়েন্দাদের হাতে আসে না। তাই ছবি দেখে কাউকে চিহ্নিত করার সম্ভাবনাও প্রায় নেই।

ছত্তীসগঢ় পুলিশে মাওবাদী দমন অভিযানের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত ডিজি আর কে ভিজ মঙ্গলবার বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সতর্কবার্তা খতিয়ে না দেখে এ ব্যাপারে সবিস্তার কিছু বলা উচিত নয়। তবে আমরা সতর্কই আছি।’’ তবে রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তা জানিয়ে দেন, দরভার হামলার পরে মহিলা মাওবাদীদের ক্ষমতা নিয়ে তাঁরা নিঃসংশয়।

দরভা ডিভিশনাল কমিটি যে ‘দণ্ডকারণ্য স্পেশ্যাল জোনাল কমিটির আওতাধীন, তাতে অন্ধ্রপ্রদেশের মাওবাদী নেতাদের প্রাধান্য বেশি। বহু সদস্যই অন্ধ্রের শ্রীকাকুলাম বা আদিলাবাদের বাসিন্দা। বাংলা বা ওড়িশার মহিলা ক্যাডারদের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে বেশি কষ্টসহিষ্ণু তরুণীদের বাহিনীতে আনার পিছনে এখানকার মাওবাদী নেতৃত্বেরই
ভূমিকা রয়েছে। শুধু জঙ্গল-যুদ্ধে পারদর্শিতা নয়, মাওবাদী ‘পিএলজিএ’ (পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মি)-র কাজকর্ম সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা ছত্তীসগঢ়ের গোয়েন্দা অফিসারেরা জানেন, এই তরুণীদের ‘আগ্রাসী মনোভাব’ বহু ক্ষেত্রেই দলের পুরুষদের থেকে বেশি।

তার হাতেগরম প্রমাণও আছে। দরভায় হামলার সময়ে মাওবাদীরা আলাদা করে মহেন্দ্র কর্মার খোঁজ করেছিল। তাঁর প্রতি বাড়তি আক্রোশ ছিল তাদের। বুলেটের ক্ষত ছাড়াও ৭৫টি ছুরির আঘাত মিলেছিল মহেন্দ্রর দেহে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, মূলত মহিলা ক্যাডাররাই তাঁর উপরে হামলা চালিয়েছিল। তাঁর দেহ ঘিরে প্রবল উল্লাসে নেচেছিলেন তাঁরা।

পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলের জন্য এই প্রমীলা বাহিনী নিয়ে কোন ছক কষেছেন মাওবাদী নেতা রামান্না? প্রশ্ন এখন সেটাই। আদতে অন্ধ্রের বাসিন্দা রামান্না ছত্তীসগঢ়, অন্ধ্র ও ওড়িশায় একাধিক নাশকতামূলক কাজে জড়িত বলে সন্দেহ করেন গোয়েন্দারা। কিন্তু রামান্নাকে বাগে পাননি তাঁরা।

প্রায় এক লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দণ্ডকারণ্য এলাকা এই মুহূর্তে সিপিআই (মাওবাদী)-র দুর্গ। এই গহন অরণ্যের নানা জায়গায় দণ্ডকারণ্য স্পেশাল জোনাল কমিটির
কাছে প্রশিক্ষিত মহিলা ক্যাডারদের নিয়ে চিন্তাটা রয়েই যাচ্ছে গোয়েন্দাদের।

অন্তত ১৫ অগস্ট পর্যন্ত তো বটেই!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE